পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্তে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন খুলনার রাষ্ট্রায়ত্ত প্লাটিনাম জুট মিলের স্থায়ী শ্রমিক আবুল হাসান। স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন মিলের পাশে একটি ভাড়া বাসায়। জানালেন, তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। মিলে চাকরির কারণে বিআইডিসি রোডের একটি বাসায় ভাড়া থাকেন। এখন মিল বন্ধ করে দিলে তার সংসার চলবে কীভাবে, ভবিষ্যতে কী কাজ করবেন, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ জোগাবেন কী করে- এ চিন্তায় দিশেহারা তিনি। মিল বন্ধ হলে গ্রামে ফিরে যেতে হবে।
একই মিলের শ্রমিক নূর ইসলাম স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে থাকেন মিলের পাশে ভাড়া বাসায়। জানালেন, তার বাড়ি রাজবাড়ি জেলায়। মিল বন্ধ হয়ে গেলে হয়তো গ্রামেই ফিরে যেতে হবে। বলেন, মিল বন্ধের পর যে টাকা দেবে তা দিয়ে কি নতুন কর্মসংস্থান হবে? পিপিপির অধীনে আবার মিল চালু হলে কাজ পাবেন কিনা?- এসব চিন্তা ঘুরছে তার মাথায়। বাসায় ফিরলে স্ত্রী বিভিন্ন প্রশ্ন করছেন এবং হাউমাউ করে কাঁদছেন।
পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্তে তাদের মতো দিশেহারা হয়ে পড়েছেন খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকলের প্রায় ২২ হাজার শ্রমিক। ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান ও সন্তানদের লেখাপড়া নিয়ে অনিশ্চয়তা আর দুশ্চিন্তা ভর করেছে তাদের মাথায়। কী করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না শ্রমিকরা। শ্রমিকদের ঘরে ঘরে চলছে কান্নার রোল।
রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক খলিলুর রহমান জানান, ষাটের দশকে স্থাপন করা মিলের যন্ত্রপাতি কখনও আধুনিকায়ন না করায় মিলের উৎপাদন ক্ষমতা কমেছে। মৌসুম শেষে বিজেএমসি অতিরিক্ত দামে কাঁচা পাট কেনায় মিলগুলোতে লোকসান হয়েছে। এ ছাড়া বিজেএমসি পাটজাত পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণ করতে পারেনি। কিন্তু সবকিছুর দায়ভার এসে পড়েছে শ্রমিকদের ওপর।
প্লাটিনাম জুট মিল সিবিএর সহ-সম্পাদক মনিরুল ইসলাম শিকদার বলেন, পাট মন্ত্রণালয় সেপ্টেম্বর মাসে শ্রমিকদের সব পাওনা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এ ছাড়া মিলগুলোকে আধুনিকায়ন করে
পিপিপির অধীনে আবার চালানোরও ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু তারা একসঙ্গে সব টাকা পাবেন কিনা, মিল আবার চালু হবে কিনা, মিল চালু হলে বর্তমান শ্রমিকরা নিয়োগ পাবেন কিনা, তা নিয়ে তাদের সংশয় রয়েছে।
প্লাটিনাম জুট মিল সিবিএ সভাপতি শাহানা শারমিন বলেন, শ্রমিকরা চাইছে মিল যেন বন্ধ করা না হয়। সে কারণে মিল বন্ধের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তারা আন্দোলনে নেমেছেন। শ্রমিকরা যদি গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের আওতায় টাকা নিয়ে বিদায় নিতে চায় তাহলে তখন আন্দোলন প্রত্যাহার করা হবে।
পাটকলের বদলি (অস্থায়ী) শ্রমিক নেতা আবদুর রাজ্জাক বলেন, স্থায়ী শ্রমিকদের পিএফ ও গ্রাচ্যুইটির টাকা দেওয়া হবে। কিন্তু ৯টি পাটকলের প্রায় ১৪ হাজার বদলি শ্রমিককে বিদায় নিতে হবে খালি হাতে। সেইসঙ্গে তারা কাজ করার সুযোগ হারাবেন।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, ৯টি পাটকলের সামনে কয়েক হাজার দোকান রয়েছে। মিল বন্ধ হয়ে গেলে দোকানগুলোও বন্ধের আশঙ্কা রয়েছে। আর দোকান বন্ধ হলে বাকি টাকাও আদায় হবে না।
এ ব্যাপারে বিজেএমসির আঞ্চলিক সমন্বয়কারী বনিজ উদ্দিন মিয়া বলেন, সরকার আর মিলগুলোর লোকসানের বোঝা টানতে পারছে না। সে কারণে সেপ্টেম্বর মাস থেকে মিলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। বিজেএমসির প্রধান কার্যালয় থেকে লিখিত নির্দেশনা পেলে সে অনুযায়ী তিনি ও ৯টি পাটকলের প্রকল্প প্রধানরা শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধসহ অন্যান্য কাজ করবেন।
অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত :এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ সংক্রান্ত কোনো চিঠি এখনও মিলে না আসায় খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকলের শ্রমিকদের চলমান অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে। এ ছাড়া বুধবার দুপুর ২টা থেকে অনুষ্ঠিতব্য আমরণ অনশন কর্মসূচি আপাতত স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদ মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এসব কর্মসূচি স্থগিত করে।
সন্ধ্যায় প্লাটিনাম জুট মিলে শ্রমিক সমাবেশ চলাকালে মিলের সিবিএ সভাপতি শাহানা শারমিন কর্মসূচি স্থগিতের ঘোষণা দেন। একইভাবে অন্য আটটি পাটকলের শ্রমিক নেতারা কর্মসূচি স্থগিতের ঘোষণা দেন। তারা জানান, আগামীকাল বুধবার যথারীতি মিলের উৎপাদন কার্যক্রম চলবে।
প্লাটিনাম জুট মিল সিবিএ সভাপতি শাহানা শারমীন বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে পাটকল বন্ধ-সংক্রান্ত কোনো চিঠি এখনও মিলে আসেনি। ফলে আগামীকাল মিল চালু হবে। এ জন্য আমরা কমসূচি স্থগিত করেছি।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক হুমায়ুন কবীর বলেন, ঢাকা থেকে মিল বন্ধের চিঠি না আসায় কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে।