সফলতার প্রয়াসে প্রাথমিকে ইতিবাচক উদ্যোগ - দৈনিকশিক্ষা

সফলতার প্রয়াসে প্রাথমিকে ইতিবাচক উদ্যোগ

মো. সিদ্দিকুর রহমান |

প্রাথমিক শিক্ষকদের ওপর সীমাহীন চাপ ও যন্ত্রণার কারণে অনেক ইতিবাচক উদ্যোগ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকারের শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে পাঠ্যবই প্রদানের উদ্যোগ নোট ও গাইড ব্যবসা ম্লান করে দিচ্ছে। বাস্তবতা হলো নোট ও গাইড বই শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থীসহ সকলের কাছে সমাদৃত। এ বিষয়টিকে নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। পাঠ্যবইকে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে অনেক প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়ায় লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের নির্ভাবনা এবং কানে সীসা গলিয়ে নিস্তব্ধ নীরব বসে থাকা দুর্নীতির আভাস দিয়ে যায়। আর কত মন্ত্রী, সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের বলবো? তবুও মাননীয় প্রতিমন্ত্রী, সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের বলছি, দয়া করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঐতিহাসিক অর্জন প্রাক-প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ নোট-গাইডের কাছে নষ্ট করে দিবেন না।

প্রাথমিকে শিক্ষার্থীর উপবৃত্তি, শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির ছোঁয়া থেকে অনেক দূরে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিস্কুট ও খাদ্য বিতরণ দরিদ্র ও তৃণমূলের জনগণের মাঝে দারুনভাবে সমাদৃত। পোশাক কেনার টাকা, স্কুল ব্যাগ বিতরণ, শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিকীকরণ, মানসম্মত করার জন্য সার্বিক সহযোগিতা করছে বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকার। এছাড়াও সচিব মহোদয়ের One Day One Word, শিক্ষকদের নিয়মিত উপস্থিত থেকে কার্যক্রম জবাবদিহিতার আওতায় এনে সফলতার মুখ দেখছে প্রাথমিক শিক্ষা। এছাড়াও ঠিকমতো পড়া বুঝতে না পারা, আত্মস্থ করতে না পারা, শিক্ষার্থীদের আলাদা করে বিশেষভাবে পড়ানোর ব্যবস্থা করার ইতিবাচক ঘোষণা মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা এগিয়ে যাবে।

সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিশুরা সাধারণত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। তারা যদি কাঙ্ক্ষিত জ্ঞান অর্জন না করে তবে ভবিষ্যত বাংলাদেশ সমৃদ্ধ হবে না। প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটলেও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার যথেষ্ট ঘাটতি রয়ে গেছে।

প্রাথমিক শিক্ষাকে ফলপ্রসূ করার জন্য শিক্ষকেরা শ্রেণিতে দুর্বল শিক্ষার্থীদের বাছাই করে আলাদা পাঠের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। বিশেষ করে ইংরেজি ও গণিত বিষয় সহজ করে ধীরে ধীরে শেখাবেন। যে শিশু ইংরেজি পঠনে দুর্বল তাদের আগামী মুজিববর্ষের মধ্যে শতভাগ পঠন দক্ষতা অর্জন করার অভিপ্রায়ে এগোচ্ছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের সচিব আকরাম আল হোসেন দাবি করেন, ৬৫ শতাংশ শিশু এখন দক্ষতার সাথে পড়তে পারে। কোন শ্রেণিতে কতজন শিশু দুর্বল তাদের তালিকা করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে জমা দিতে হবে। শতভাগ শিক্ষার্থীকে কার্যকর পাঠদান নিশ্চিত করতে হবে।

সচিব আকরাম আল হোসেন বলেন, ইউনেস্কোর সর্বশেষ প্রতিবেদন লার্নিং টু রিয়ালাইজ এডুকেশন প্রমিজ ২০১৮ তে বলা হয়েছে, পঞ্চম শ্রেণির ১০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে পাঠ্যপুস্তকের সাধারণ গণিত ২৫ জন সমাধান করতে সক্ষম। তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩৫ শতাংশ রিডিং পারে। অধিকাংশ শিক্ষার্থী পাঠে দুর্বল থাকায় মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন হয়ে উঠে না।

বর্তমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫৯৩টি। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে প্রশংসনীয় কার্যক্রমে প্রধান চ্যালেঞ্জ শিক্ষক সংকট ও পাঠদান বহির্ভূত অসংখ্য কাজের ব্যাপকতা। স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষক সংকট বেড়েই চলেছে। শিক্ষার্থী বৃদ্ধির সাথে সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষক সংকট দূর করা যাচ্ছে না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সংকট ও পাঠদান বহির্ভূত কাজ জন্ম থেকে হয়ে আসছে। বর্তমানে এর ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষার্থী বৃদ্ধির সাথে সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষক সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়নি। অবসর গ্রহণ, মৃত্যুজনিত, শিক্ষকতা পেশা থেকে চলে যাওয়া, নানা ছুটিতে থাকা শিক্ষকদের শ্রেণির কার্যক্রম দায়সারাভাবে চলে। শিক্ষক নিয়োগে দীর্ঘসূত্রিতা, অনুপস্থিত শিক্ষকদের ক্লাস নেয়ার ভাবনা প্রতিমন্ত্রী, সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের মাঝে আছে বলে দৃশ্যমান নয়। শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি নিয়ে বছরের পর বছর সময়ক্ষেপণ মন্ত্রণালয়ের ইতিবাচক পদক্ষেপগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে হাবুডুবু খাচ্ছে। এর ব্যর্থতার দায় দিতে তখন ইউনেস্কো, এনজিও, সুধী সমাজ, সংশ্লিষ্টরাসহ সর্বমহল প্রাথমিক শিক্ষকদের দায়ী করতে খানিকটাও বিলম্ব করবে না।

শিক্ষক সংকটেও দায়িত্বশীল শিক্ষকরা সকাল ৯টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত একটানা বিরামহীনভাবে ক্লাস করে থাকেন। কোনো কোনো বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষককে একই সাথে একাধিক ক্লাস করতে হয়। শিক্ষক সংকটে One Day One Word এবং দুর্বল শিক্ষার্থীদের বিশেষ পাঠের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত অর্জনের বিষয়টি স্বপ্ন বা কাগজের মধ্যে আটকে যায়। অপরদিকে, সংশ্লিষ্টরা প্রাথমিক শিক্ষকদের পাঠদান বহির্ভূত নানাকাজে ব্যস্ত রেখে শিক্ষার্থীদের পাঠে ক্ষতির কথা বেমালুম ভুলে যায়। তাদের বক্তব্য, প্রাথমিক শিক্ষকেরা সরকারি কর্মচারী। তাই তাদের ছুটির দিনেও কাজ করতে হবে। কত ছুটি যে প্রাথমিক শিক্ষকদের কপাল থেকে হারিয়ে যায় তার খবর কে রাখে? তারপরেও প্রাথমিক শিক্ষকদের সংশ্লিষ্টদের সহানুভূতি থেকে বঞ্চিত হতে দেখা গেছে।

প্রাথমিকের অনেক ছুটি কিতাবে আছে বাস্তবে নেই। তাদের অবস্থা অনেকটা ‘না বাপের বাড়িতেও ঠাঁই, না আছে স্বামীর বাড়িতে’ প্রবাদের মতো। ৬৫ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখা ও আনাচে কানাচে অসংখ্য কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয় আজ শিশু শিক্ষার কাজে জড়িত। তাদের সংখ্যাও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চেয়ে কম নয়। এই কিন্ডারগার্টেনগুলোর দায়িত্ব না নিয়ে শুধুমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কর্মপরিকল্পনা আগামী প্রজন্মের মাঝে বৈষম্য সৃষ্টি করার নামান্তর। এ কাম্য হতে পারে না। এ প্রেক্ষাপটে সকল শিক্ষার্থীর জন্য বৈষম্যহীন মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে কতিপয় সুপারিশ উপস্থাপন করছি।

১. প্রাথমিক শিক্ষকদের দৈনিক সর্বোচ্চ ৩টি ক্লাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা প্রয়োজন। এ জন্য শিক্ষক নিয়োগ দেয়া জরুরি। শিক্ষক সংকট শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে হবে। যাতে শিক্ষার্থীদের পাঠদান দায়সারাভাবে না করতে হয়।
২. শিশু শিক্ষার বাইরে সকল কাজ থেকে শিক্ষকদের মুক্ত রাখতে হবে।
৩. কিন্ডারগার্টেনসহ সকল শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অভিন্ন (কর্মঘণ্টা, বই ও মূল্যায়ন) ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
৪. যে সকল প্রতিষ্ঠান শিশু শিক্ষায় সরকারি বিধি অমান্য করবে, তাদের বিনা মূল্যের বই ও সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে অব্যাহতি দিতে হবে।
৫. কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি।
৬. বেসরকারি বা কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয় থেকে শিশু শিক্ষার ভেজাল মুক্ত করার লক্ষ্যে কঠোর আইনের প্রয়োগ করে তা বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

শিশু শিক্ষার মধ্য থেকে সকল বৈষম্য দূর করাসহ মন্ত্রণালয়ের ইতিবাচক পদক্ষেপ বাস্তবায়নে সকলের আন্তরিক প্রয়াস কামনা করছি।

মো. সিদ্দিকুর রহমান : সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ; সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষাডটকম।

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.006202220916748