সব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা অনুষদ চালু হোক - দৈনিকশিক্ষা

সব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা অনুষদ চালু হোক

আমিরুল আলম খান |

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বা ইউনিভার্সিটি টিচার্স টেনিং একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হবে। এমন একটি খবর প্রকাশ করেছে অনলাইন পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকম। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ! খবরটা রীতিমত আঁতকে ওঠার মত শোনায় এদেশে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কাড়ি কাড়ি গবেষণা করেন। দেশি-বিদেশি জার্নালে সেসব প্রকাশিত হয়। তাদের নামের সাথে শোভা পায় ডক্টরেট ডিগ্রি। অনেকের তো পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা আছে বিস্তর। এখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তাদের প্রশিক্ষণের জন্য একোডেমী খুলবেন। খবরটি সত্যিই চমকে দেয়ার মতই। 

কিন্তু না, কোন ভুল নেই খবরে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কাজী শহীদুল্লাহ বলেছেন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করা ও বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে স্থান পেতে ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল, সেন্ট্রাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বা ইউনিভার্সিটি টিচার্স টেনিং একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হবে। স্ট্র্যাটেজিক প্লান ফর হায়ার এডুকেশন ২০১৮-২০৩০ এ বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে ও বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে স্থান পেতে এসব প্রতিষ্ঠান কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। গত ৭ সেপ্টেম্বর অনলাইন প্লাটফর্মে আয়োজিত স্ট্র্যাটেজিক প্লান ফর হায়ার এডুকেশন বাস্তবায়নে গঠিত তত্ত্বাবধান কমিটির প্রথম সভায় সভাপতির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি (দৈনিক শিক্ষাডটকম, সেপ্টেম্বর ৭, ২০২০)। 

ডিগ্রি অর্জন করলেই শিক্ষক হওয়া যায় এমন একটা ধারণা আমাদের সমাজে যেন বদ্ধমূল হয়ে আছে। কিন্তু পৃথিবীর কোন দেশে শুধু ডিগ্রি অর্জন করেই শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হওয়া যায় না। এজন্য পেশাজীবি হিসেবে শিক্ষকদের শিক্ষা বিজ্ঞানে বিশেষ ডিগ্রি অর্জন করতে হয়। আর সেটা একেবারে হাতেকলমে।

কিন্তু বাংলাদেশে শুধু প্রাথমিক এবং টেনেটুনে মাধ্যমিক শিক্ষকদের জন্য পেডাগজি প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা গেছে। কলেজ শিক্ষকরা এখনও এর বাইরে। তাদের জন্যও যে পেডাগজি অধ্যয়ন বাধ্যতামূলক করা উচিত সে চিন্তা করো মাথায় ঢোকে নি আজ পর্যন্ত। না শিক্ষকদের, না কর্তৃপক্ষের। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ তাই একেবারে আকাশ থেকে পড়ার মত খবর বটে। জ্ঞান অর্জন আর জ্ঞান বিস্তরণ যে একই কর্ম নয়, সেটা আমাদের সমাজ এখনও স্বীকার করতে নারাজ। 

গবেষণা নিজের জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করে। কিন্তু শিক্ষাবিজ্ঞানে অর্জিতসে জ্ঞান কীভাবে শেখায় কীভাবে সে জ্ঞান শিক্ষার্থীদের মাঝে কার্যকরভাবে পৌঁছে দেয়া যায়। শুধুমাত্র ক্লাসে বক্তৃতাদান আর যাই হোক শিক্ষাদান হতে পারে না। এ পদ্ধতিতে কেবল শিক্ষক সক্রিয় থাকেন; কিন্তু শিক্ষার্থী থাকে নিষ্ক্রিয়। কিন্তু কেবলমাত্র সক্রিয় শিক্ষার্থীই শিখতে পারে, ধারণ ও চর্চা করতে পারে। আর তাই সেই প্রাচীন কালে গ্রিস মনীষী সক্রেটিস নিজে প্রশ্ন করে করে শিষ্যদের সক্রিয় রাখতেন। শিষ্যরা গুরুর তত্ত্বাবধানে সত্যের সন্ধান করত।
 
শিক্ষকের জ্ঞানের ভাণ্ডার জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে বিতরণের মত কোন কাজ নয়। শিক্ষা হল শিক্ষার্থীর সক্রিয় অংশগ্রহণে প্রত্যাশিত জবাব খুঁজে বের করার কৌশল। গাছ যেমন শেকড় দিয়ে মাটি থেকে প্রয়োজনীয় পানি নিজেই চুষে নিতে পারে, পাতার সবুজ ক্লোরোফিল সূর্যের আলোর সাহায্যে যেমন খাদ্য তৈরি করে নিতে পারে তেমনি শিক্ষার্থীরও সত্যিকারের মানুষ হবার জন্য নিজের প্রয়োজনীয় খাদ্য (জীবন দক্ষতা) নিজেই অর্জন করার জন্য উপযুক্ত করে তোলার নাম শিক্ষা। 

বার্ট্রান্ড রাসেল মোক্ষম কথাটি বলেছেন। তার মতে, শিক্ষকের কাজ জ্ঞানদান নয়, জ্ঞান অর্জনের কৌশল রপ্ত করানো। কিন্তু আমাদের দেশে দুর্বল শিক্ষার্থীকে বিবেচনা করেন স্রেফ শূন্য কলসি হিসেবে। নবীন শিক্ষার্থীদের প্রতি এরচেয়ে বড় অপমান দ্বিতীয়টি নেই। শিক্ষকরা তাদের জ্ঞানের সীমাহীন ভাণ্ডার উজাড় করে দিতে সক্রিয় থাকেন ক্লাসে। ক্লাসে নিষ্ক্রিয় শিক্ষার্থী ঘরে ফিরে রাত জেগে তা মুখস্থ করে আর পরীক্ষার খাতায় উগরে দেয়। 

বাস্তবে প্রয়োগ-অযোগ্য এমস ডিগ্রি নিয়ে কর্মবাজারের সকল দরজা তার জন্য থাকে বন্ধ হয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অতলান্ত জ্ঞানে পেট চলে না। নিয়োগকারীর অভিযোগ তারা উপযুক্ত কর্মী পায় না। সার্টিফিকেটধারীর আক্ষেপ, তাদের কেউ কাজে নেয় না। একরাশ হতাশা গ্রাস করে যৌবনদীপ্ত সম্ভাব্য কর্মীদের। এরএক চূড়ান্ত প্রকাশ দেখা যায় সরকারি চাকুরিতে প্রবেশে বয়স ৩৫ বছর করার দাবির মধ্যে। অথচ দুনিয়া জুড়ে কর্মজীবনে প্রবেশের বয়স ধরা হয় ২৫ বছর। এ বয়সে কর্মজীবন শুরু করে ২৮-৩০ বছর বয়সের মধ্যে পছন্দ মত বিয়ে থা করে যারা ঘর সংসার পেতে বসতে পারে তারাই পারে সন্তানদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে। আমাদের দেশে জীবনের স্বর্ণালী কাল কেটে যায় হতাশার সাগরে ভেসে। ক্লান্তি আর হতাশা যখন চরমে ওঠে তখন ডিগ্রির তুলনায় অনেক নিচের ধাপে কোন একটা কাজে ঢুকে জীবনকে অভিসম্পাত করাই তাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়। 

এই ঘেরাটোপে বাঁধা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। তা থেকে মুক্তির পথ সন্ধানে সক্রিয় ভূমিকায় না দেখা গেছে রাষ্ট্রের কর্ণধারদের, না এদেশের বুদ্ধিজীবী মহলের। শিক্ষা জীবনে কাজ করা হালে এতই অমর্যাদাকর হয়ে উঠেছে যে, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি প্রতি বৃহস্পতিবারে শিক্ষার্থীদের স্কুলগৃহ সাফছুতরো করার আহ্বান জানিয়ে রীতিমত দুয়োধ্বনি শুনেছেন। অথচ আমাদের বাল্য-কৈশরকালে স্কুলগৃহ, আঙিনা পরিচ্ছন্ন রাখা, নির্মাণ সামগ্রী মাথামুটে বয়ে আনা ছিল রীতিমত গৌরবের। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের কালে এ দেশের অভিভাবকদের মানসিকতার এহেন অধঃপতনের কারণ অনুসন্ধান করা একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। 

আমরা মনে করি, শিক্ষার আবশ্যকীয় শর্ত হবে, কায়িক পরিশ্রমে পড়ুয়াদের নিয়োজিত করে জীবন দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করা। আর এসব কাজ করতে হলে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল পর্যায়ের শিক্ষকদের জন্য পেডাগজি, এন্ডাগজি অধ্যয়ন বাধ্যতামূলক করার বিকল্প নেই। আর তা করার এখনই সময়। কেতাব মুখস্থ করিয়ে ডিগ্রি দেবার দিন এখন বাসি। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা হবে একই সাথে তাত্ত্বিক ও কর্মভিত্তিক। স্বেচ্ছাসেবা, কৃষি, দোকানদারি থেকে কারখানায়, অফিসে কাজ করেই (ইন্টার্নশিপ) ডিগ্রি অর্জন বাধ্যতামূলক করতে হবে। সে শিক্ষা কারিগরি বা মানবিক যাই হোক না কেন। শিক্ষাক্রম সাজাতে হবে সেভাবেই।

আমাদের শিক্ষা মানসম্মত নয়, এমন কি দক্ষিণ এশীয় মানদণ্ডেও তা যোজন যোজন পিছিয়ে। স্বাধীনতার পর অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও আমাদের কোন বিশ্ববিদ্যালয় এশীয় র‌্যাংকিংয়ে জায়গা পায় না। অথচ এককালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হত “প্রাচ্যের অক্সফোর্ড”। এক্ষেত্রে আমাদের ইতিহাস শুধু পিছিয়ে পড়ার। কিন্তু গোটা জাতি এখন এই নিষ্ঠুর সত্যি উপলব্ধি করছে যে, বৈশি্বক মানদণ্ডে সম্মানজনক আসন না পেলে এদেশের শিক্ষার নামে সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হবে।

কথায় বলে, ভাল কাজ দেরীতে হলেও ভাল। এতদিনে যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এই সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছে সেজন্য তাদের সাধুবাদ জানাই। তবে এ উপলব্ধি কতখানি স্বতোৎসারিত, আর কতখানি বহিরারোপিত সে প্রশ্ন থেকেই গেল। ইউজিসি এক যুগে বাস্তবায়নের এক বৃহৎ প্রকল্প (স্ট্র্যাটেজিক প্লান ফর হায়ার এডুকেশন ২০১৮-২০৩০) হাতে নিয়েছে। তাতে বিদেশি সহায়তা আর ঋণ যে আছে তা বলাই বাহুল্য। প্রকল্প নির্ভর উন্নয়ন প্যারাডাইম দেশের খুব মঙ্গল করেছে তেমন নজির অতীতে নেই। হোসেন জিল্লুর রহমান “কাজের বিনিময়ে খাদ্য” কর্মসূচি নিয়ে গবেষণা করে দেখিয়েছেন, সুফলের চেয়ে প্রকল্পনির্ভর উন্নয়র প্রয়াস কুফল দিয়েছে বেশি। দুর্নীতি ছড়িয়েছে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত। তিনি এর নাম দিয়েছেন “গম সংস্কৃতি” বা হুইট কালচার। বিদেশি সাহায্যে শুরু করা প্রকল্পের আরেকটা সর্বনাশ হল, প্রকল্প শেষে এর দায়িত্ব নিতে সরকারের গড়িমসি; এবং শেষপর্যন্ত যদি নেয়ও তবে তার বারোটা বাজিয়ে। 

এখন দেখার বিষয় ইউজিসি ঠিক কী ধরনের শিক্ষক প্রশিক্ষণ একাডেমি স্থাপনে উদ্যোগ নিচ্ছে। তবে যে কোন উন্নয়ন প্রচেষ্টাই হওয়া উচিত সামগ্রিক চিন্তায় (হলিস্টিক এ্যাপ্রোচ) থেকে। অবকাঠামো ও প্রশাসনিক খাতে বিপুল অপচয় এড়াতে একটা সহজ সমাধান হতে পারে, দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা অনুষদ চালু করা। উল্লেখ করা যেতে পারে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরুই হয়েছিল শিক্ষা অনুষদ চালুর মাধ্যমে। দেশে এখন প্রায় প্রত্যেক জেলায় একটাকরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে বা হচ্ছে। তাই প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা অনুষদ চালু করতে বাঁধা নেই।  

শুধু সদিচ্ছা আর সঠিক পরিকল্পনা থাকলেই কিন্তু এটা দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে নির্দেশনা দিলে দেশে এক যুগান্তকারী উন্নয়ন সাধিত হবে।

লেখক : আমিরুল আলম খান, শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান যশোর শিক্ষা বোর্ড।

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0047788619995117