সবকিছুতে এগিয়ে বিদ্যাময়ী - দৈনিকশিক্ষা

সবকিছুতে এগিয়ে বিদ্যাময়ী

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় যে সড়কের ওপর, তার একটি পোশাকি নাম আছে—রামবাবু রোড। স্কুলের দাপটে সড়কের নামটাই ঘুচতে বসেছে এখন। এই জনপদ, বসতবাটি বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান—সবকিছুর কেন্দ্রেই এখন বিদ্যাময়ী। এদের ঠিকানা বিদ্যাময়ীর উত্তর–দক্ষিণ–পূর্ব বা পশ্চিমে, মুখোমুখি কিংবা উল্টো দিকে। বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শেখ সাবিহা আলম।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বালিকা বিদ্যালয়টি এত কিছুকে ছাপিয়ে গেল কী করে? উত্তর পেতে ঘাঁটতে হলো পুরোনো অনেক নথিপত্র। জানা গেল, বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে নারীশিক্ষার অগ্রগতিতে প্রাচীন এই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা বলে শেষ করার নয়। 

জেলা গেজেটিয়ারে বলা হচ্ছে, উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ময়মনসিংহ অঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলতে ছিল মক্তব–মাদ্রাসা ও টোল। জেলায় এমন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না, যা অন্য অঞ্চলের মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারে। মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অভাব ছিল, আর খ্যাতনামা বংশগুলোর কাছে বিত্তই ছিল প্রধান।

এমন এক প্রেক্ষাপটে ১৮৩৫ সালে জনশিক্ষা কমিটির প্রেসিডেন্ট লর্ড মেকলে ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের সুপারিশ করলেন। সে সময়ের গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের হাত ধরে ধীরে ধীরে শিক্ষাক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন এল। এরই ধারাবাহিকতায় বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ের জন্ম। ১৮৭৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিদ্যাময়ীকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি।

মজার ব্যাপার হলো, শুরুতে কিন্তু স্কুলটির নাম ছিল আলেকজান্ডার ইংরেজি বিদ্যালয়। তখন প্রধান শিক্ষক ছিলেন নবকুমার সমাদ্দার। স্কুলটির বিকাশে অনেকেই এগিয়ে এসেছিলেন, তবে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছিলেন মুক্তাগাছার জমিদার রাজা জগৎ কিশোর আচার্য চৌধুরী। পরে তাঁর মা ‘বিদ্যাময়ী দেবী’র নামেই স্কুলটির নামকরণ করা হয়। তখন প্রধান শিক্ষক ছিলেন শ্রীমতী ভক্তিসুধা ঘোষ। স্কুলটি সাড়ে তিন একরের বেশি জায়গার ওপর দাঁড়িয়ে।

মূল ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢোকার মুখেই কালের সাক্ষী এক প্রাচীন রাধাচূড়াগাছ। বাঁ দিকে টলটলে জলের বিশাল পুকুর। পুকুর পেরিয়ে খেলার মাঠ। মাঠের দক্ষিণ দিকে শহীদ মিনার। মাঠ পেরোলে দোতলা ছাত্রীনিবাস। স্কুল হওয়ার আগে জমিদারবাড়ির নাচঘর হিসেবে ব্যবহৃত হতো এই ভবন, এমন একটি জনশ্রুতি আছে। আছে ছয় হাজার বইসমৃদ্ধ একটি গ্রন্থাগার।

এখন বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাছিমা আক্তার। গত ১৬ অক্টোবর তাঁর কক্ষে ঢুকতেই চোখ গেল রবীন্দ্রনাথের বাঁধানো ছবিতে। বিশ্বকবি দাঁড়িয়ে আছেন বিদ্যাময়ীর লাল দালানের সামনে, পেছনে ছাত্রী ও শিক্ষকেরা। প্রধান শিক্ষিকা বললেন, ১৯২৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্কুলে এসেছিলেন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ভবন নির্মাণের সাহায্যে সে সময় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কবির হাতে ১০১ টাকা তুলে দিয়েছিলেন।

প্রধান শিক্ষিকার দপ্তর পুরস্কারে বোঝাই। থরে থরে সাজানো অসংখ্য ক্রেস্ট—ক্রেস্টগুলো বিভিন্ন আকৃতি ও নকশার। কোনো কোনোটিকে বেশ প্রাচীন মনে হয়, সাল–তারিখ লেখা নেই তাতে। নাছিমা আক্তার ও তাঁর সহকর্মীরাই হাসিমুখে ঘুরে ঘুরে দেখালেন সব। তাঁরা বলছিলেন, লেখাপড়ায় তো বটেই, এ স্কুলের ছাত্রীরা নাচ–গান–অভিনয়–উপস্থিত বক্তৃতা–বিতর্ক–রচনা প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে সদ্য শুরু হওয়া শুদ্ধ সুরে জাতীয় সংগীত পরিবেশনেও পুরস্কার নিয়ে এসেছে। স্কুলে ভর্তির জন্য মেয়েরা খুব কষ্ট করে।

চতুর্থ শ্রেণিতে ২৪০টি আসনে পরীক্ষার্থী থাকে আড়াই–তিন হাজার। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারে ২৮ জন, পরীক্ষা দেয় ৬০০ জন। যেদিন ভর্তি পরীক্ষার ফল বেরোয়, হাসিমুখের পাশাপাশি, ছোট ছোট মেয়ে আর তাদের বাবা–মায়েদের কান্নার দৃশ্যও দেখতে হয়। এ দৃশ্য বড় কষ্টের।

কথার সত্যতা পাওয়া গেল অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনায়। সাবেক এক মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী বুলবুল আহমেদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল নতুনবাজারে এক চায়ের দোকানে। তিনি বলছিলেন, মেয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষা দেবে। দুটি কোচিং বাইরে করে, দুজন শিক্ষক বাসায় এসে পড়ান। এ বছর যত দূর সম্ভব অন্যান্য কাজ থেকে দূরে আছেন। মেয়েকে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করছেন।

একবার ভর্তি হয়ে গেলে নিশ্চিন্ত। কেন নিশ্চিন্ত? বুলবুল বললেন, ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান, বছরের পর বছর পরীক্ষায় ভালো করে আসছে। এ অঞ্চলের মানুষের স্বপ্নই হলো মেয়েকে বিদ্যাময়ীতে ভর্তি করানো।

কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেল, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট, এসএসসিতে স্কুলের পাসের হার প্রায় শতভাগ। গত বছর একটু পিছিয়েছিল, পাসের হার ছিল ৯৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ। কেউ কেউ পরীক্ষায় অংশ নেয়নি, তার প্রভাব পড়েছে পরীক্ষার ফলে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষাতেও ভালো করেছে মেয়েরা। 

১৯৮৮, ১৯৯২, ১৯৯৬ ও ২০০২ সালে বিদ্যাময়ী জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পায়। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে প্রধান শিক্ষক সেরা শিক্ষক মনোনীত হয়েছেন। স্কুলের শিক্ষকেরা বললেন, প্রতিবছর মেডিকেল, বুয়েট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েই নিয়মমাফিক দেখা করতে আসে ছাত্রীরা। গত বছর, এক ব্যাচের ৪৮ জন সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছে।

দীর্ঘদিন এই স্কুলে শিক্ষকতা করে সদ্য অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে গেছেন নীলা সরকার। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটে বিদ্যাময়ীর মেয়েরা শিক্ষকতা করছেন, চিকিৎসক আছেন, কূটনীতিক আছেন, প্রশাসন–পুলিশেও বিদ্যাময়ীর ছাত্রীরা আছেন। শিক্ষকেরা বলছিলেন, তাঁদের মেয়েদের দম ফেলার সুযোগ নেই।

লেখাপড়া ছাড়াও সারা বছর তারা নানা কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত। বার্ষিক মিলাদ মাহফিল দিয়ে শুরু, এরপর ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, রবীন্দ্র–নজরুল জন্মোৎসবসহ নানা জাতীয় উৎসব আছে। সবই সাড়ম্বরে পালিত হয়। জাতীয় শিশু–কিশোর প্রতিযোগিতা, জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ, শিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত প্রতিযোগিতায় ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ছয়টি স্বর্ণপদক পেয়েছে মেয়েরা, পুরস্কারের ঝুলিতে ওই একই সময়ে যুক্ত হয়েছে দুটি ব্রোঞ্জপদক।

বিজ্ঞান কুইজ, ভাষাবিদ প্রতিযোগিতায় জিতে এসেছে তারা। স্কুলে হলদে পাখি, গার্ল গাইড, যুব রেড ক্রিসেন্টের কার্যক্রম আছে। সম্প্রতি স্কুল থেকেই মেয়েদের জন্য জুডো কারাতে শেখানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আকর্ষণীয় অনেক উৎসবের মধ্যে স্টুডেন্টস কেবিনেট নির্বাচন শিক্ষকদের চোখে অন্যতম। তবে এত প্রাপ্তির মধ্যেও শিক্ষকদের একটাই দুঃখ। মেয়েরা আজকাল খেলতে চায় না।

বিদ্যাময়ীর মেয়েরা আর তাদের মায়েরা কী বলছেন? অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী শ্রেয়া রায়ের মা রীমা রায় বলছিলেন, ময়মনসিংহে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তবু বিদ্যাময়ী সেরাদের সেরা। সব মেয়ে ভালো। তাই প্রতিযোগিতাটা একটু বেশি। এ প্রতিযোগিতাটা একটু চাপ হয়ে যায়। তবে ছাত্রীরা তাদের মায়েদের কথার সঙ্গে একমত নয়। তৃষা পণ্ডিত, নিশাত তাসনিম, নিশাত রুম্মান—এই তিন বন্ধুর মতে, স্কুল মানে ‘মজা’। বাসায় যত খারাপই লাগুক, স্কুলে এলেই মন ভালো।

১৬ অক্টোবর স্কুল ঘুরে ছাত্রীদের নানা কর্মকাণ্ড দেখালেন শিক্ষক আয়েশা আক্তার খাতুন। স্কুলের নানা বাঁকে ঝুলছে বিষয়ভিত্তিক দেয়াল পত্রিকা—নাম শ্রাবণধারা, মেঘদূত, অরোরা। ফেরার সময় অফিস রুমের সামনে বেজায় ভিড়। আয়েশা হেসে বললেন, বৃত্তির টাকা দেওয়া হচ্ছে। ২০০ জনের মতো ছাত্রী বৃত্তি পেয়েছে। ‘মেয়েরা লক্ষ্মী হয়ে দাঁড়াও’—এ কথা শুনে ছাত্রীরা পথ করে দিল। সবার মুখে হাসি। কেউ কেউ হাত তুলে দেখাল বিজয় চিহ্ন।

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0057370662689209