একজন শিক্ষক হিসেবে প্রতি বছর নতুন শিক্ষাবর্ষের প্রথম ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সাথে গল্প করেই সময় পার করে দেই আমি। উদ্দেশ্য একটাই, তাদের জড়তা কাটিয়ে তোলা। শিক্ষকতার শুরু থেকেই প্রথম ক্লাসে শিক্ষার্থীদের পরিচয় জানার চেষ্টা করি। এতে তাদের জড়তা অনেকটাই কমে যায়।
আর একটি বিশেষ প্রশ্ন করি তা হলো, পড়াশোনা শেষ করে জীবনে তারা কী হতে চায়। জবাবে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পুলিশ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, আইনজীবী হওয়ার আকাঙ্ক্ষী পেয়ে যাই। কিন্তু খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থী শিক্ষক হওয়ার অভিব্যক্তি প্রকাশ করে।
যাই হোক এবার মূল কথায় আসা যাক। আজ পর্যন্ত কোন শিক্ষার্থীর এমন অভিব্যক্তি পাইনি, যে ভবিষ্যতে রাজনীতিবিদ হতে চায়। আমার শিক্ষার্থীদের মুখ থেকে মূলত যে উত্তরটির জন্য তাদের ভবিষ্যৎ ভাবনা জানতে চাই, সেটাও পাইনি বললেই চলে। শিক্ষার্থীরা কেউ বলে না, তারা একজন ভালো মানুষ হতে চায়। এতে আর তাদের কী দোষ? অভিভাবকরা তাদের সন্তান গর্ভে থাকাবস্থায় সন্তানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দিচ্ছেন। আগেরটাকে ডাক্তার আর পরেরটাকে ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন।
ছোটবেলা থেকেই তাকে এভাবেই গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। সন্তানকে ভাত খাওয়ানোর সময় বলা হয় ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার হতে হলে বেশি বেশি খেতে হবে। কত স্বপ্ন, কতো ত্যাগ বাবা-মা'র।
সন্তান পরীক্ষায় প্রথম স্থান না পেলে রাগারাগি, মন খারাপ করে বাবা-মাই খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেন। মনে হয় তাদের অন্তর হিরোশিমায় পরিণত হয়েছে। অথচ তাদের সন্তান প্রথম হতে পারেনি মাত্র এক দুই নম্বরের ব্যবধানে। কী আজব দুনিয়ায় বসবাস করছি আমরা!
আমি মাঝে মধ্যেই ছোট বাচ্চাদের দেখি বইবোঝাই করা ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর সিলেবাস পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবির মতো। একেকটি বিষয়ের তিন চারটে করে বই। এতো বই দেখে আমি নিজেই ভয় পাই।
জীবনের শুরুতেই কোমলমতি শিশুদের বইয়ের প্রতি ভয় ধরিয়ে দেয়া হয়। যে শিশুকে রাত জেগে পড়াশোনা অর্থাৎ হোমওয়ার্ক রেডি করতে হয়। ভোরবেলা পাখির ডাকে ঘুম না ভেঙে, ধমক খেয়ে ঘুম থেকে উঠতে হয়। সেই শিশুর জন্য এই সুন্দর পৃথিবী কতটা নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ?
এখনকার অভিভাবক অনেক সচেতন। তাই তো খেলাধুলা করে তাদের সন্তানরা সময় নষ্ট করুক এটা চান না। বাচ্চারা খেলাধুলা কি সেটা দিনে দিনে ভুলেই যাচ্ছে। কারণ তারা যে খেলার প্রতি দিনে দিনে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে, সে খেলার সাথে ধুলার কোন সম্পর্ক নেই। এটাই চরম বাস্তবতা।
আমরা ছোটবেলায় পড়েছি খেলাধুলা শরীর ও মনে প্রশান্তি আনে। কিন্তু কোথায় সে খেলাধুলা! আমাদের সন্তানরা তো অনেক নামকরা খেলোয়াড়ও হতে পারে। অন্য যেকোন দিকে তার প্রতিভা থাকতে পারে। আমরা তাদের প্রতিভার মূল্যায়ন করতে পারি না। আমরা শুধু চাই সোনায় মোড়ানো জিপিএ ফাইভ। এটাই আমাদের এইম ইন লাইফ। নিজে যা পারিনি সন্তানকে দিয়ে তা বাস্তবায়ন করার যুদ্ধে নামা।
আধুনিক জীবন যাপনের ক্ষেত্রে পশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতি আমাদের ঝোঁক অনেক বেশি। আমরা তাদের অনুসরণ করি পোশাকে, খাওয়া দাওয়া, বিনোদন ইত্যাদির ক্ষেত্রে। কিন্তু তাদের বাচ্চাদের শিক্ষা পদ্ধতির দিকে নজর দেয়ার কোন আগ্রহ কি কখনও দেখিয়েছি?
আমাদের বাচ্চাদের ইংরেজিতে সবল করে গড়ে তোলার জন্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াই। এই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এখন ধনী অভিভাবকদের স্যোসাল স্ট্যাটাসে পরিণত হয়েছে। আহারে! ভাবতেই ভুলে যাই আমাদের প্রকৃত পরিচয়। বাচ্চা বাংলা বলতে না পারলেও ইংরেজি বলতে হবেই।
ভদ্র সমাজে দু’চারটে ইংরেজির ব্যবহার তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে বৈকি! আমরা একটি বিদেশী ভাষা বাচ্চাদের শেখাতে চাই ভালো কথা, কিন্তু বাংলার প্রতি অনিহা প্রকাশ করে কেন?! স্থান-কাল-পাত্রভেদে প্রয়োজনের তাগিদে আমাদের ইংরেজি শিখতে হয়।
যেহেতু ইংরেজিকে আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়েছে। আমাদের সন্তানরা ইংরেজিতে একটু খারাপ করলেই আমরা অনেক বকাঝকা করি। ইংরেজি শিক্ষকরাও কেমন যেন ব্রিটিশদের মতো আচরণ করেন। তার ইংরেজি শুনে যদি কেউ ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত বলে তাহলে মনে মনে খুশিতে আটখানা হয়ে যান।
কিন্তু একজন ব্রিটিশ শিক্ষার্থীকে যদি বাংলা ভাষা রপ্ত করতে দেয়া হয়, তাহলে কি সে আমাদের মতো শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ সারা জীবনে করতে পারবে? আমার বিশ্বাস হয় না। যদি তাই হতো তাহলে বহু বছর যাবৎ যেসব ব্রিটিশরা বাংলাদেশে আছেন তাদের মুখে বাংলা শুনে আমাদের হাসির উদ্রেক হতো না।
বাংলা যদি আন্তর্জাতিক ভাষা হতো তখন ব্রিটিশদের দৌড় দেখা যেত। তারা কতো ভালো করে বাংলা বলতে পারে।
সম্মানিত অভিভাবক আপনাদের বোঝানোর ক্ষমতা আমার নেই। আমি নিজেও একজন অভিভাবক। তাই আমার লেখাতে কিছুটা অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছি। অসুন সন্তানের ইচ্ছের প্রাধান্য দেই। তাদের প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর সুযোগ করে দেই। বইয়ের বোঝা পিঠে চাপিয়ে তার মেরুদণ্ডকে ভেঙে না দেই। তাদেরকে বাঁচতে শেখায়। স্বপ্ন দেখতে শেখায়। খেলার সাথে ধূলোর সম্পর্কে বাধা না দেই। বাস্তবতা বুঝতে শেখায়। আত্মনিয়োগ, আত্মনিয়ন্ত্রিত ও আত্মনিবেদিত হতে শেখায়। অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই, পৃথিবী সবসময় নতুন প্রজন্মকেই চাই। আর এটাও সত্য যে, প্রথম হওয়া সফলতা নয়, সবার মন জয় করাই সফলতা।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট।