নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ পৌরশহরে গড়ে ওঠা ‘বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়’ এর সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিক্ষক নিয়োগসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এমনকি বিদ্যালয়ের নামে ১৫ শতক জায়গা কেনা নিয়েও বিভিন্ন জাল-জালিয়াতির অভিযোগে আদালতে একটি মামলাও রয়েছে বলে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পৌর শহরের কলেজ রোডস্থ ‘ডনভিউ’ নামে একটি কিন্ডার গার্টেনের প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুর রব খান ঠাকুর ২০১৮ সালে ওই বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তিনি পৌর শহরের মাইলোড়া এলাকার বাসিন্দা উপজেলা আ.লীগের সহ সভাপতি ও জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আব্দুল হান্নান রতনকে ওই বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি করা হয়। আর সুচতুর শিক্ষক আব্দুর রব খান ঠাকুর তিনি নিজে ওই কমিটিতে সদস্য সচিবের পদে থেকে তিনি আবার ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদটিও হাতিয়ে নেন।
নিয়মানুযায়ী ১১ সদস্য বিশিষ্ট ওই বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের কমিটি গঠন করা হলেও কমিটির অন্যান্য সদস্যদেরকে কোনো কিছু না জানিয়ে তারা দুজনেই বিদ্যালয়টির সকল কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। আর এরপর সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক তারা দুজনে মিলে ওই বিদ্যালয়ের জন্য প্রথমেই ১৯ জন শিক্ষক এবং বিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্টাফ হিসেবে আরো ১৬ জনকে নিয়োগ দেন।
নিয়োগকৃত ওইসব শিক্ষকদের কাছ থেকে তারা জন প্রতি দেড় লাখ টাকা করে ও আফিস স্টাফদের কাছ থেকেও জন প্রতি আরো ৫০-৮০ হাজার টাকা করে নিয়ে সর্বমোট ৩০-৩৫ লাখ টাকা তারা দুজনে হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে, পৌরসভার মাইলোড়া মৌজার ৫৪ খতিয়ানের ৩৬৮ দাগে ১৫ শতক জায়গা জাল জালিয়াতির মাধ্যমে বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি অ্যাড. আব্দুল হান্নান রতন নিজের নামে দলিল করে নেন এবং পরে তিনি তা পুনরায় ওই বিদ্যালয়ের নামে দানপত্র দলিল করে দিয়ে বিদ্যালয়ের দাতা সদস্য বনে যান। পরে ওই জমির প্রকৃত মালিক দাবিদার শিল্পী আক্তার নামে ওই এলাকার বাসিন্দা বাদী হয়ে ২০১৮ সালে আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। কিন্তু বিদ্যালয়ের ওই জায়গা নিয়ে আদালতে মামলা চলমান থাকাবস্থায় চলতি বছরে জেলা পরিষদ থেকে ৫ লাখ টাকা অনুদান এনে বর্তমানে সেখানে একটি হাফ-বিল্ডিং নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে।
অন্যদিকে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রব ঠাকুর প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই ওই প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়টির কার্যক্রম তিনি তার ‘ডনভিউ’ নামে পুরাতন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই চালিয়ে আসছেন। আর তিনি ওই বিদ্যালয়ের ঘরভাড়া বাবদ প্রতি মাসে ৩ হাজার ৫ শত টাকা করে হাতিয়ে নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া তিনি ওই বিদ্যালয়ে কাগজে পত্রে ৩২০ জন শিক্ষার্থী দেখিয়ে সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে আসলেও বাস্তবে গিয়ে ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী পাওয়া যায় ২০-২২ জন।
ওই বিদ্যালয়ের জমির প্রকৃত মালিক দাবিদার ও আদালতে দায়েরকৃত মামলার বাদী শিল্পী আক্তার বলেন, প্রতিবন্ধী স্কুলের জায়গাসহ ওখানে আমাদের মোট ৩০ শতাংশ জায়গা রয়েছে। ১৯৮৪ সালে বাবা এটি কেনার পর থেকেই আমার বাবা ওই জমিটি চাষাবাদ করে আসছিলেন। কিন্তু ২০১৮ সালে আ.লীগের প্রভাবশালী নেতা হান্নান রতন ও নয়ন ভেন্ডার নামে তার এক আত্মীয়সহ তারা তাদের লোকজন নিয়ে আমাদেরকে মারধর করে উচ্ছেদ করে জায়গাটি তাদের দখলে নিয়ে যায় এবং এ নিয়ে আদালতে মামলা থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে তারা ওই জায়গায় প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড লাগিয়ে সেখানে একটি ঘর নির্মাণ করছেন।
বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য উপজেলা আ.লীগ নেতা সুলতান আহমেদ জানান, বিদ্যালয়ের জায়গা নিয়ে তো সমস্যা রয়েছেই। পাশাপাশি সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক মিলে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বিদ্যালয়ে ১৯ জন শিক্ষক ও আরো ১৬ জন স্টাফ নিয়োগ দেয়াসহ কোনো বিষয়েই তারা কমিটির অন্যান্য সদস্যদেরকে অবগত করেননি। এমনকি এ পর্যন্ত তারা কমিটিকে নিয়ে কোনো মিটিং পর্যন্ত করেননি।
বিদ্যালয়ের অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুর রব খান ঠাকুর বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও স্টাফ নিয়োগ দিয়ে টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, 'মূলত তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ওই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি ফান্ড তৈরি করেছি। এমনকি ওই টাকা থেকে ৯ লাখ টাকা দিয়ে বিদ্যালয়ের জন্য ১৫ শতাংশ জায়গা ক্রয় করেছি এবং জায়গাটি দলিল করাসহ মোট ১১ লাখ টাকার মতো খরচ করেছি।'
বিদ্যালয়ের ফান্ডের টাকা দিয়ে জায়গা ক্রয় করার পরও আ.লীগ নেতা আব্দুল হান্নান রতন ওই বিদ্যালয়ের জমিদাতা কিভাবে হলেন? এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়েই তিনি এ প্রতিনিধিকে বলেন, ' ভাই দয়া করে সংবাদটি প্রকাশ কইরেন না। আমি আপনার সাথে এসে দেখা করব।'
বিদ্যালয়ের সভাপতি ও জমিদাতা অ্যাডভোকেট আবদুল হান্নান রতনের কাছে এ বিষয়ে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে আপাতত সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য এ প্রতিনিধিকে সুপারিশ করেন এবং তিনি বলেন, 'এ বিষয়টি নিয়ে আমি আগামী দু’একদিনের মধ্যেই আপনাদেরকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন ডেকে সব পরিস্কার করে জানিয়ে দেব।'
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুজ্জামান বলেন, 'ওই প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়টির বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে মৌখিকভাবে আমার কাছে অনেকেই অভিযোগ করেছেন। তবে বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখব।'