বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বহুদিন ধরে চেষ্টা করছে সমন্বিত বা গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষা নিতে; কিন্তু এখন পর্যন্ত কার্যকর করতে পারেনি। ‘বুয়েটের পরীক্ষা আগের মতোই’- এ শিরোনামে সম্প্রতি দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে; যেখানে বলা হয়েছে, বুয়েটের শিক্ষা পরিষদ আগের মতোই ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল। বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এ নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, যদিও সংবাদে বিষয়টি খোলাসা করা হয়নি; তারপরও যতদূর বোঝা যায়- তারা আগের মতোই পরীক্ষা নেবে, গুচ্ছ পদ্ধতিতে নয়। বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া উচিত- তারা কেন অনাগ্রহী সমন্বিত পরীক্ষা নিতে বা তারা না আসতে চাইলে কেন আসতে চাইছে না, এর পেছনে কী যুক্তি; এর ব্যাখ্যা তারা দিক। আজ এ বিষয়ে ইউজিসির সভা রয়েছে। সুতরাং বিষয়টি এখনই সামনে আসা উচিত।
প্রথমে গুচ্ছভিত্তিক পরীক্ষার কথা আলোচনা হলেও কিছুদিন আগে কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষার কথা বলেছে ইউজিসি। যদিও গুচ্ছভিত্তিক পরীক্ষাই মানতে চাইছে না প্রথম সারির চারটি বিশ্ববিদ্যালয়; কেন্দ্রীয় পরীক্ষা তো আরও দূরের ব্যাপার। কেন্দ্রীয় পরীক্ষা পদ্ধতি আসলেই একটু জটিল হবে; সুতরাং এটা নিয়ে কথাবার্তা থাকলেও সমন্বিত বা গুচ্ছ পদ্ধতির পরীক্ষা না মানার ক্ষেত্রে কোনো যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে না।
কারণ, বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজগুলো একটি পরীক্ষার মাধ্যমে খুব সহজে পরীক্ষার কার্যক্রম সম্পন্ন করে আসছে এবং মেধাতালিকার ভিত্তিতে ভর্তি কার্যক্রম চালাচ্ছে।
এখন ধরুন, এবার থেকে মেডিকেল কলেজগুলো যদি সিদ্ধান্ত নেয়- তারা আর একসঙ্গে পরীক্ষা নেবে না। ৩৯টি সরকারি মেডিকেল কলেজ যদি আলাদাভাবে পরীক্ষা নেয় এবং একজন ছাত্র যদি ১০টি মেডিকেল কলেজ থেকে ফরম তোলে এবং প্রতিটি ফরমের মূল্য যদি গড়ে ৪৫০ টাকা করে হয় তাহলে ফরম বাবদ তাকে ৪ হাজার ৫০০ টাকা গুনতে হবে।
আর তার বাড়ি যদি পঞ্চগড়, রাঙ্গামাটি বা যে কোনো প্রান্তের জেলা হয় তাহলে আসা-যাওয়া ও থাকাসহ একটি পরীক্ষায় কমপক্ষে ২ হাজার টাকা খরচ হয় (ওই সময় পরিবহনগুলো ইচ্ছেমতো ভাড়া বাড়িয়ে থাকে; আমাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শহরের বাসভাড়া ২০ টাকা কিন্তু ভর্তি পরীক্ষার সময় ৫০-৬০ টাকা পর্যন্ত নেয়া হতো।
শুধু বাস নয়, হোটেলগুলোরও ছিল একই অবস্থা। ভর্তি পরীক্ষার দিন তাদের জন্য ঈদের দিন। ইচ্ছেমতো দাম নিত) তাহলে ১০টি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা গুনতে হবে। শারীরিক পরিশ্রম ও ধকলের কথা বাদই দিলাম।
কেউ কেউ ভাবতে পারেন, ২৫-৩০ হাজার টাকা এমন আর কী! যাদের বাবা কৃষক, যাদের বাবা দিনমজুর, যাদের বাবা সামান্য বেতনের কর্মচারী; তারা বুঝে ২০ হাজার টাকার মর্ম।
গতবার আমার পরিচিত এক ছোট ভাই বলল- ভাই, ঢাকা আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ৭ হাজার শেষ। আর টাকা নাই। বাবার টাকা নাই, বড় ভাইও কষ্ট করে দিছে; আর দিতে পারছে না। কী করব, বলেন! কী জবাব দিব আমি তাকে! এটা আমাদের দেশের বেশিরভাগ দরিদ্র পরিবারের প্রতিচ্ছবি।
আমি নিজেও তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশি পরীক্ষা দিতে পারিনি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সুবাদে দেখলাম, ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীই নিু মধ্যবিত্ত পরিবারের; যারা টিউশনি ব্যতীত চলতে পারে না। হলে থাকার সুবাদে দেখলাম অনেকের অনেক রকম কষ্ট। অনেকেই আছে, যাদের বাবা নেই। অনেকের বাবা থাকলেও দিনমজুর।
এ ধরনের ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভর্তি পরীক্ষার নামে ‘ভর্তি বাণিজ্য’ করলে তা কতটা যৌক্তিক? মূলত এ জন্য ইউজিসি গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার কথা বলছে। অনেকের মনে প্রশ্ন থাকতে পারে, গুচ্ছ বা সমন্বিত পদ্ধতি পরীক্ষা কীভাবে হবে? এ বিষয়ে ইতিমধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে; বিষয়টি একেবারেই সহজ। যেমন-
১. সব সরকারি মেডিকেল কলেজের জন্য একটি পরীক্ষা হবে। মেধাক্রম ও পছন্দ অনুসারে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হবে।
২. সব সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি গুচ্ছে ৪-৫টি ইউনিটে বা ভাগে ভাগ করে পরীক্ষা হবে। যেমন-
A ইউনিট- বিজ্ঞান বিভাগের (Science)
B ইউনিট- মানবিক বিভাগের (Arts)
C ইউনিট- ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের (Business Studies)
D ইউনিট- বিভাগ পরিবর্তনের ( Combined)
৩. ৭টি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি গুচ্ছ করে পরীক্ষা নিলেই চলবে। প্রয়োজনে এখানে চাইলেও ইউনিট করে নিতে পারে। (কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অভিনন্দন জানাচ্ছি; কারণ গত বছর ৭টি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অলরেডি গুচ্ছ পদ্ধতিতে সফলভাবে পরীক্ষা ও ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে)।
৪. সব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গুচ্ছ করে পরীক্ষা।
৫. বুয়েট, চুয়েট, রুয়েট, খুয়েটকে গুচ্ছ করে সমন্বিত পরীক্ষা। প্রয়োজনে ইউনিট করে নেবে।
আমাদের সেশনে একটি ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিন্যান্স বিভাগে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পরও শুধু বাড়ি চট্টগ্রাম হওয়ার কারণে সে ঢাবি বাদ দিয়ে চবিতে ভর্তি হয়েছিল। কারণ তার বাসা চট্টগ্রাম। আবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার পরও বন-জঙ্গল বলে ভর্তি না হয়ে একজন ভর্তি হয়েছে ঢাকা কলেজে; কারণ, সে ঢাকার বাসিন্দা।
এরকম ব্যতিক্রম আছে, থাকবে এবং থাকাটা স্বাভাবিকও বটে। ৩৮তম বিসিএসে এমন একজনকে ভাইভা দিতে দেখলাম, যিনি ৩৬তম বিসিএসএ প্রশাসন ক্যাডারে অলরেডি কর্মরত। ৩৮-এ ভাইভা দিতে এসেছেন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের পরিবর্তে শিক্ষা ক্যাডারে যাওয়ার জন্য। আমি খুবই অবাক হলাম। অবশ্য পরে পরে হল- অবাক হওয়ার কী আছে! তার পছন্দ।
এ জন্যই গুচ্ছ পদ্ধতিতে চয়েস লিস্ট দিয়ে দিলেই হয়। সাধারণত সবাই বুয়েটকে ফার্স্ট চয়েসই দেয়ার কথা। কিন্তু কেউ যদি বলে, আমি দূষিত শহর ঢাকায় যাব না; নির্মল বায়ুর শহর রাজশাহীতে থাকব, রুয়েটে পড়ব। তাকেও সে সুযোগ দেয়া উচিত। যেমন বিসিএসে চয়েস অনুযায়ী ক্যাডার দেয়া হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় চান্স পাওয়ার পর চয়েসের ভিত্তিতে প্রাপ্ত স্কোর অনুযায়ী সাবজেক্ট দেয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রথম চয়েস রাখবে স্বাভাবিকভাবেই; কিন্তু কেউ যদি জাহাঙ্গীরনগর কিংবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম চয়েস রাখতে চায় রাখতে পারবে এমন সুযোগ রাখলে কারও আপত্তি থাকবে না ঢাবির পরে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরিয়াল আগে আসবে আর কোনটার সিরিয়াল পরে আসবে।
ছাত্রছাত্রী বা পরীক্ষার্থীরা নিজেই পছন্দ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের চয়েস দেবে যেমন তারা একাধিক সাবজেক্টের মধ্যে ক্রমান্বয় চয়েস লিস্ট দিয়ে থাকে। মেধাক্রম অনুযায়ী যে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাবে; সেখানে ভর্তি হবে।
এভাবে হলে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা আলাদা ফরম কেনা লাগবে না; আর আলাদা আলাদা ফরম বাবদ ফিও দেয়া লাগবে না। আবার অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার্থীদের নিকটতম বা দূরতম আত্মীয় অথবা প্রতিবেশীও থাকে না; ফলে কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে- এসব ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
সবচেয়ে বেশি ভেজাল করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এরা প্রতিবছর একদিন আগে পরে তারিখ দিয়ে; এমনকি একই দিনে পরীক্ষা নেয়ার ঘটনাও আছে। খুবই আশ্চর্য লাগে- তারিখ নির্ধারণ করলে ফরম পূরণের আগেই দিন তাহলে ছাত্রছাত্রীরা আগেই পছন্দ করে নেবে- কোথায় পরীক্ষা দেবে আর কোথায় দেবে না। ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার পর পরীক্ষা থেকে বঞ্চিত করার অধিকার আপনাদের কে দিল?
ইউজিসির সমন্বিত বা গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। যে কোনো মূল্যে সমন্বিত পরীক্ষার উদ্যোগ কার্যকর করতে হবে। প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি; যাতে ভর্তি পরীক্ষার নামে ‘ভর্তি বাণিজ্য’ করে গরিবের টাকা নিয়ে কেউ ছিনিমিনি খেলতে না পারে।
লেখক :রমজান আলী, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়