গত ২০ মার্চ সমকাল পত্রিকার একটি কলাম প্রকাশিত হয় ‘সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা এবং জনমিতির সুবিধা’ শিরোনামে। লেখক ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সুলতানা মোসতাফা খানম। লেখাটির মাধ্যমে রাষ্ট্রের এবং শিক্ষাব্যবস্থার গভীর কিছু সংকট অকপটে উঠে এসেছে। তাঁর লেখাটি পড়ে আমার কিছু প্রশ্ন ও প্রতিক্রিয়া সবিনয়ে পেশ করতে চাই।
বাংলাদেশে অনেক দিন যাবৎ সমন্বিত বা গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা এবং স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে নানান মহল থেকে পাল্টাপাল্টি মতামত আসছে। পরস্পরবিরোধী মতগুলোর একটি মিলের জায়গা হচ্ছে- সকল পক্ষই শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ কমানো এবং শিক্ষার মান বৃদ্ধির পক্ষে। কিন্তু বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে ঘোর অমিল।
ড. সুলতানা ম্যাডাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা কতটা পবিত্র এবং কঠোর নিয়মের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়, তার নমুনা দিতে গিয়ে বলেছেন, “পরীক্ষার্থীদের ঘাড় ঘুরানোর সুযোগও দেন না”। এই সামান্য কথাটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতি কতটা নির্মম এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক কোন স্তরে নেমেছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক কতটা অনাস্থা-অবিশ্বাসের। কোনো পরীক্ষার্থী শারীরিক কারণেও ঘাড় ঘুরাতে পারেন। একজন শিক্ষক কি সেক্ষেত্রেও পরীক্ষার্থীকে হল থেকে বের করে দেবেন?
আমি বিশ্বাস করি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা খুব সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়। কিন্তু কঠোর আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে একজন শিক্ষকের ভাষা আর আইনশৃংখলা বাহিনীর ভাষা কি একই হতে পারে? শিক্ষক একজন শিক্ষার্থীর অনেককিছু বিবেচনা করেন, যা আইনশৃংখলা বাহিনীর পক্ষে অসম্ভব। শিক্ষকদের প্রতি যেমন শিক্ষার্থীরা সম্মান প্রদর্শন করবে, শিক্ষার্থীদের প্রতিও একটি শ্রদ্ধার মনোভাব থাকা উচিত। শিক্ষার্থীদের প্রতি এমন নির্মমতা এবং অসম্মান পোষণ করে, আমরা কীভাবে তাঁদের কাছ থেকে সম্মান আশা করবো, কীভাবে আমরা তাঁদের অভিভাবকত্ব দাবি করবো? প্লেটো তাঁর ‘আইনকানুন’ গ্রন্থে বলছেন, শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধাবোধ শেখানোর জন্য বকা দিয়ে নয় বরং তাঁদের সম্মান করে শেখাতে হবে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, বর্তমান পদ্ধতিতে পরীক্ষার্থীরা বড় আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন। একজন পরীক্ষার্থীকে তাঁর আগ্রহের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরীক্ষা দিতে ফরম পূরণ, জেলায় জেলায় অভিভাবকসহ যাতায়াত, থাকা-খাওয়া মিলিয়ে কমপক্ষে ৭০ হাজার টাকা খরচ হয় (২৬ অক্টোবর, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রচারিত ডিবিসি নিউজ চ্যানেলের টক শো অনুসারে)। বাংলাদেশে একজন শ্রমিকের বা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের ন্যূনতম বেতনের পরিপ্রেক্ষিতে এই ব্যয় কতটুকু যৌক্তিক?
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা একটি নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাবার সময় একবার যানজটের কারণে পরীক্ষা হলে উপস্থিত হতে অনেক দেরি করেছি, একবার টঙ্গীতে রেলের বগি লাইনচ্যুত হওয়াতে ভর্তি পরীক্ষাই দিতে পারিনি। ডিবিসি চ্যানেলের টক শোতে বলা হয়েছে, একজন পরীক্ষার্থীকে ভর্তি পরীক্ষা দিতে মোটামুটি তিন মাসে চারবার বাড়ি যাবার ফুরসত মিলে এবং তাকে গড়ে সাত হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। এতটা পথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত একজন ভালো মানের পরীক্ষার্থীও ভালোভাবে পরীক্ষা দিতে পারে না। পরীক্ষার্থীদের সাথে সাথে অভিভাবকদেরও এই পথ ছুটতে হয়। অনেক সময় মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে সন্তানকে নিয়ে এসে এক অভিভাবক হিটস্ট্রোকে মারা যান।
নতুন একটি জায়গায় আবাসিক সমস্যায়ও পড়তে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হলগুলো আগত পরীক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের অনায়াসে ছেড়ে দেন। এখানে অনেক ভর্তি পরীক্ষার্থীকে গাদাগাদি করে রাত কাটাতে হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি দেখেছি, একজন অভিভাবক তাঁর মেয়েকে নিয়ে এসেছেন। বাবাকে থাকতে হয়েছে ছেলেদের হলে আর মেয়েকে মেয়েদের হলে। আবাসিক হোটেলগুলো এই সময় বেশি চার্জ করে। তাছাড়া হলগুলোতে খাবারের পরিবেশ ভালো না, বাইরে খেতে গেলে অনেক খরচ হয়।
কিছু কিছু পরীক্ষা একই দিনে হবার কারণে ফরম পূরণ করেও পরীক্ষা দিতে পারেন না অনেকে। অনেক সময় একই পরীক্ষার্থী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান, একটিতে ভর্তি হয়ে, আবার ভর্তি বাতিল করে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি বাতিল করতেও হাজার হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। ভর্তি পরীক্ষার স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখার দোহাই দিচ্ছেন অনেকে। ফলে কোচিং ব্যবসাকে প্রকারান্তরে উৎসাহিত করা হচ্ছে। একজন পরীক্ষার্থী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে বিভিন্ন ধরনের কোচিং এ দৌড়াতে হচ্ছে।
আবার সন্তানকে পরীক্ষায় নিয়ে যেতে চাকরিজীবী অনেক অভিভাবক এতদিন ছুটি পান না। এতগুলো পরীক্ষার বদলে কয়েকটি পরীক্ষা নিয়ে যদি পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা যেত, তাহলে অভিভাবকদের ব্যয়ও অনেক কমে যেত এবং শিক্ষার্থীরাও প্রস্তুতি নিতে বেশি সময় পেত। সবটা মিলিয়ে নাগরিকদের মূল্যবান সময় এবং রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির শিকার থেকে রক্ষা পেত।
শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক সুলতানা ম্যাডাম ভর্তি পরীক্ষার কাজে শিক্ষকদের ‘মজুরি’ কম বলেছেন। তিনি বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নির্দেশ আছে ব্যয় নির্বাহের নিজস্ব খাত তৈরির। আমি বিশ্বাস করি না, সত্যিকারের কোনো শিক্ষক নিজের পারিশ্রমিকের জন্য শিক্ষার্থীর ভোগান্তি করতে নৈতিকভাবে রাজী আছেন। আমাদের রাষ্ট্র বিভিন্ন বিদেশি সংস্থার পরামর্শে বিশ্ববিদ্যালয়কে যখন গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আয়ের নিজস্ব খাত তৈরির নামে শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির জন্য বলছেন, স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় বলে যারা দাবি করি, তারা কি জোর অবস্থানে বলতে পেরেছি শিক্ষার ব্যয় রাষ্ট্রকেই বহন করতে হবে? আমি শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধার বিপক্ষে কখনো নই। বিভিন্ন দেশের তুলনায় আমাদের দেশের শিক্ষকরা অনেক কম উপার্জন করে জীবন ধারণ করেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের অনৈক্যের সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনৈতিক উপায় অবলম্বন করেই শিক্ষকদের বাঁচতে হবে।
ম্যাডাম শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিয়ে বলেছেন। স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এর বিরুদ্ধে কোনো সমন্বিত পদক্ষেপ কি আমরা নিতে পেরেছি? সমন্বিত বা গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা হলে প্রভাবশালী মহলের চাপ, কেন্দ্র দখল, প্রশ্নফাঁস ইত্যাদি সমস্যার চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সমস্যার সমাধান রাষ্ট্রের কাছে বা মহামান্য আচার্যের কাছে চাইতে হবে। অন্যথায় আমরা সবাই বর্তমান সমস্যাকে অনুমোদন দিচ্ছি, এটাই প্রমাণিত হবে।
বাংলাদেশে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা শিক্ষার্থীদের মান বুঝাতে ম্যাডাম “আই এম জিপিএ ফাইভ” এর উদাহরণ টানলেন। এটা প্রমাণ করে, আমরা আমাদের পাবলিক পরীক্ষা এবং শিক্ষার মান নিয়ে কতটা হতাশ এবং রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত পরীক্ষা পদ্ধতির উপর আমাদের কতটা আস্থাহীনতা! এর বিরুদ্ধেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেক কিছু করার আছে বলে আমি মনে করি। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এই পরীক্ষাকে যতই সমালোচনা করি না কেন, এসব পরীক্ষার ফলাফল বিচার করেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়।
“একবারই পরীক্ষা দেবার সুযোগ” -সমন্বিত বা গুচ্ছ পদ্ধতির বিরুদ্ধে অবস্থানকারী অনেক পরীক্ষার্থীর এটাই আসল ভয়। সমন্বিত বা গুচ্ছ পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীরা একটি বা দুটির বেশি পরীক্ষা দিতে পারবে না। তাই তাদের অন্তত দ্বিতীয়বার পরীক্ষার সুযোগ দেবার কথা কর্তৃপক্ষ ভাবতে পারে। দ্বিতীয়বার পরীক্ষার আগেই তাদের কিছু নম্বর কাটা যেতেই পারে।
স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেরাও একটি গুচ্ছ করে নিতে পারেন। ইতোমধ্যে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিচ্ছে। তাদের অভিজ্ঞতা আমরা কাজে লাগাতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের নিজস্ব মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিতে পারেন।
পরীক্ষার্থীরা ফরম পূরণের সময় সেই অনুসারে পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভাগ ঠিক করে নিতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় বা বিভাগ মেধা তালিকার অল্প কিছু পরীক্ষার্থীকে আভ্যন্তরীণ পরীক্ষা নিয়ে চূড়ান্ত নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারেন। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের সাথেও মতবিনিময় করা যায়। সমন্বিত, গুচ্ছ বা অঞ্চলভিত্তিক যেমনই হোক, আমাদের কথা ভর্তি পরীক্ষার বিদ্যমান পদ্ধতি পরিবর্তন-পরিমার্জন করা দরকার।
লেখক : হাসান তৌফিক ইমাম, প্রভাষক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন।]