সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চালু হলে কমবে ভোগান্তি - দৈনিকশিক্ষা

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চালু হলে কমবে ভোগান্তি

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

গত ১৭ জুলাই সারা দেশের এইচএসসি ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। মোটামুটি সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই চার মাস চলবে জীবনের মূল লড়াই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে পদ্ধতিতে ভর্তিপ্রক্রিয়া চালু আছে তাতে দেখা যায়, ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থীদের ছুটতে হয় এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে, এক জেলা থেকে আরেক জেলা, এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে, দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ভর্তি পরীক্ষার তারিখ একই দিনে হলে তাঁদের অনেকেই বিপাকে পড়েন। এ ছাড়া কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ পর পর থাকায় অধিক দূরত্বের কারণে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা অনেক শিক্ষার্থীর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অনেক শিক্ষার্থী এই পরিস্থিতির শিকার হয়ে পছন্দের বিষয়টিতে ভর্তি হতে পারেন না; এমন বিষয়ে ভর্তি হতে বাধ্য হন, যা তিনি পড়তে চাননি। অনীহা নিয়ে কোনো কাজ শুরু করলে তার চূড়ান্ত ফলাফল অমঙ্গলজনক হয়। এর ফলে তিনি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেন না। রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে প্রথম বর্ষে স্নাতক ভর্তি পরীক্ষার সময়সূচি অনুযায়ী এ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ‘চ’ ইউনিটে ও একই দিন বিকেলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ২০ ও ২১ সেপ্টেম্বরে সকাল-বিকাল একইভাবে বাকি ইউনিটে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবছর ঢাকার এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সময়সূচিতে সমন্বয় দেখা গেলেও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কোনো সমন্বয় লক্ষ করা যায় না। গত বছর বিজ্ঞানের একজন পরীক্ষার্থীকে কী পরিমাণ ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল তার একটি ছক দেওয়া যাক : ২০ অক্টোবর খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা শেষ করে পরদিন ৪০৩ কিলোমিটার রাস্তা ভ্রমণ করে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে হয় তাঁকে। এর পরদিন ২২ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে জীববিজ্ঞান ইউনিটের পরীক্ষা হলে ওই শিক্ষার্থীকে আরো কয়েক শ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করতে হয়।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, অক্টোবর মাসে ১৫ দিনের মধ্যে আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে একজন শিক্ষার্থীকে প্রায় দুই হাজার ৩৬০ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করতে হয়েছিল। নভেম্বরের ৩ থেকে ১৩ তারিখের মধ্যে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়  (নোবিপ্রবি), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি), হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (হাবিপ্রবি), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমরকৃবি), যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি) ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) ভর্তি পরীক্ষা পর পর অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে ৯-১০ দিনে ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে বিজ্ঞানের একজন পরীক্ষার্থীকে প্রায় এক হাজার ৩৬৪ কিলোমিটার অর্থাৎ গড়ে প্রায় প্রতিদিন ২২৭ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করতে হয়। এরপর ১৭ থেকে ৩০ নভেম্বর এবং ডিসেম্বরের প্রথম ও দ্বিতীয় দিনসহ মোট ১৬ দিনে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে একই সময়ে অর্থাৎ ১৭ নভেম্বর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি); ১৮ নভেম্বর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও কুবি; ২৪-২৫ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) এবং ২৬-৩০ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারিত হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থীর পক্ষে নভেম্বর মাসের অনেক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে গড়ে প্রায় ২৫০.৫ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করতে হয়। এটা শুধু গত দু-এক বছরের চিত্র তা নয়; আমার অভিজ্ঞতা মতে, গত ২০ থেকে ২৫ বছর ধরেই চলছে পরীক্ষার্থী ভোগান্তির এই করুণ গল্প।

কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি অতিদ্রুত চালু করতে দেরি হলে অন্ততপক্ষে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবকরা সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি কেন্দ্রীয় রুটিন এমনভাবে করতে পারেন, যাতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ভোগান্তির শিকার না হন এবং একজন শিক্ষার্থী যোগ্যতা অনুযায়ী তাঁর পছন্দের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বা সব বিষয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দূরত্ব বিবেচনা করে কাছাকাছি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিষয়ভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার তারিখ পাশাপাশি করা যেতে পারে এবং বেশি দূরত্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে কমপক্ষে এক সপ্তাহ বিরতি দিয়ে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করা যেতে পারে। 

কেন্দ্রীয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি চীন, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিলসহ বিশ্বের অনেক দেশেই রয়েছে। বাংলাদেশে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে ক্যাডার ও নন-ক্যাডার চাকরির পরীক্ষা, মেডিক্যাল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষা, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। যদিও বিষয়টি নিয়ে অনেক কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন, তবে দেশের যোগাযোগ, অধিক শিক্ষার্থী ও আর্থ-সামাজিক দিকগুলো বিবেচনা করে কেন্দ্রীয় পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

পরীক্ষার্থীদের এই ভোগান্তি দূর করতে অতীতে চেষ্টাও হয়েছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপাচার্যদের ডেকে মন্ত্রী মহোদয় মিটিং করেছিলেন। বলেছিলেন, কিভাবে এ প্রক্রিয়া চালু হতে পারে। মহামান্য রাষ্ট্রপতিও অভিন্ন পরীক্ষার বিষয়ে নানা পরামর্শ দিয়েছিলেন। পরীক্ষার্থীরা কিভাবে পরিত্রাণ পাবেন এ নাকাল অবস্থা থেকে সে পথ বলেছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নেতৃত্বে একটি কমিটিও হয়েছিল। সেখানে ছিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিসহ বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা নানা সুপারিশ করেছিলেন বলে আমি জানি। যখন ভর্তিপ্রক্রিয়া শুরু হয় ঠিক তার আগে এই মিটিং করে কর্তৃপক্ষ। যার দরুন ওই সময়েই বিষয়টি নিয়ে হৈচৈ শুরু হয় আবার দুদিন পর সব চুপচাপ।

ইংল্যান্ডে UCAS (Universities collages admission service) নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। সেখানে দেশ-বিদেশের এমনকি অনেক দেশ থেকে আবেদনপত্র জমা পড়ে ভর্তির জন্য। UCAS সে আবেদনপত্র বাছাই করে ও পরীক্ষার আয়োজন করে। ফলে পুরো ভর্তি পরীক্ষা নিয়মমাফিক, সুষ্ঠুভাবে এবং এক দিনেই শেষ হয়ে যায়। ইংল্যান্ডে এত বড় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে বাংলাদেশে কেন সম্ভব নয়? এখানে অনেক দক্ষ জনবল আছে, কাজ করার মানুষ আছে। দরকার শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের। UCAS-এর মতো বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকারের কমিশন থাকতে হবে। তাদের কাজ হবে সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি নিয়ে কাজ করা। তারাই শিডিউল তৈরি করবে, তাদের হাতে ক্ষমতা দেওয়া হবে। তারা পরীক্ষার্থীর যোগ্যতা ও পছন্দমতো সব মিলিয়ে মেধাক্রম, ভর্তি, অবস্থান নিরূপণ করবে। এ জন্য দরকার সরকারের দৃঢ় ইচ্ছা।

এ জন্য প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টদের উদার মানসিকতা ও আর্থিক সুবিধাদি ত্যাগের মানসিকতা। অনেকেই জোর দাবি তোলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনে হস্তক্ষেপ করা যাবে না, তাদের ভর্তি নিয়ে কথা বলা যাবে না। নিজস্ব আইন আছে। হ্যাঁ, আমিও মানছি তা। কিন্তু গত কয়েক দশকে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। নিয়ম-নীতিতে এসেছে আধুনিকতা। এ মুহূর্তে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তির জন্য প্রয়োজন একটি আইন পাস করা। স্বায়ত্তশাসন ঠিক রেখে শিক্ষার্থীদের ধকল কমাতে এই আইন সংসদের মাধ্যমে পাস করা যেতে পারে।

 

লেখক : ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.014795064926147