উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষা সমাপ্তির আগে থেকেই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীদের দুর্দশাদর্শীরা নানা পরামর্শ নিয়ে ছাপা কাগজের পৃষ্ঠায় নিবেদন জানিয়ে আসছেন। ভিনদেশের মোহ ত্যাগ করে, দেশে পদ-পদবির জন্য ভাঁড় না সেজে যথার্থ শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবাল নকিবদের মতো সামনে থেকে দুর্দশাগ্রস্ত ভর্তীচ্ছু এবং অভিভাবকদের পক্ষ হয়ে কলমের কালি খরচ করে চলেছেন। অনেকেই এই শুভ উদ্যোগের সহগামী। দুঃখের বিষয় বাস্তবায়ন যাদের কবজায়, তারা পিঠে কুলো আর কানে তুলো দিয়ে নির্বিকার। এরা কি নিজেদের এক স্বৈরশাসকের মতো ভাবছেন!
আমাদের শিক্ষা বিভাগে নানা কৌশলে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা বলছেন, বড় কিছু পেতে হলে বড় ত্যাগের দরকার। আজকের বিশ্বে শিল্প একটি উত্তম বিনিয়োগ, মানুষ হওয়া নয়। সুতরাং অর্থক্ষয় এবং শরীর পাত না করলে কী মোক্ষলাভ ঘটবে? হায়! এক অভিনব পরিহাস! মনুষ্যত্বহীন শিক্ষা, মোক্ষলাভের পন্থা!
উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষা শেষ হলে ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থী আর তাদের অভিভাবকদের হৃৎকম্পন শুরু হয়। আরেক শ্রেণি অর্থপ্রাপ্তির লিপ্সায় অসাধু ব্যবসায়ীদের মতো পালা-পার্বণে ক্রেতার পকেট কাটার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। বেচারা আমপাবলিকের বিধিলিপির খণ্ডন হয় না।
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করলে ভর্তিকারীদের স্বার্থ বিঘ্নিত হবে মৌসুমি অর্থপ্রাপ্তির। কে না জানে, বাইরের ঠাটবাট দেখাবার অন্যতম হাতিয়ার, মীর মশাররফ হোসেনের ভাষায় ‘পাতকী অর্থ’। সবাই তো এই পাতকী অর্থ দিয়ে বিলাস-বৈভব গড়ে তুলছে। প্রশ্ন উঠবে, ভর্তির ক্ষমতাবানরা তো মানুষ। তাদের বেলায় উচ্চবাচ্য কেন? হ্যাঁ, তারাও মানুষের ঊর্ধ্বে নয় স্বীকার্য। তবে তারা ব্যতিক্রমী। দুঃখ হয়, শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যখন অধঃপাতে যায়, তখন আফসোস করে বলতে ইচ্ছা করে—বাবা, অতই যখন বিলাস-ব্যসনের কামনা, তখন শিক্ষা নামের পবিত্র অঞ্চলে হানা দেওয়ার কী দরকার ছিল? আসলে গূঢ় রহস্য পাবলিক জানে। রাষ্ট্রের উচ্চ আসনে বসার জন্য মেধার অভাবে, নানা পন্থায় ভ্যাট দিয়ে সুলভ কর্মসংস্থান শিক্ষা বিভাগে আসা। তাই সেই বিনিয়োগের অর্থ সুদে-আসলে উসুল করা। আর এ জন্য শিক্ষা ও শিক্ষকের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে।
একদা প্রকৃত শিক্ষা ও শিক্ষিতের মর্যাদা ছিল সামন্ত দরবারেও। ভালো শিক্ষকদের উত্তম পরামর্শক হিসেবে বেছে নেওয়া হতো। দরবারের জন-নিপীড়ন কর্মকাণ্ডে নিরাসক্ত শিক্ষক সমর্থন প্রত্যাহার করতেন। প্রয়োজনে প্রতিবাদী হয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। আমাদের যাত্রা উল্টো পথে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানের স্থান থেকে সমন্বিত পরীক্ষা গ্রহণের অনুরোধ উপেক্ষিত!
প্রকৃত শিক্ষক তাঁরাই, যাঁরা নিজে বেঁচে অপরকে বাঁচার পথ দেখান, তাঁদের দৃষ্টি জননীর মতো, পকেটের দিকে নয়, মুখের পানে।
যার যার তার তার মতো স্বাধীন ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণে অতি ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা অসহনীয় যন্ত্রণা ভোগ করে আসছেন। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত এফোঁড়-ওফোঁড় করে। আর কন্যা ভর্তিপ্রার্থী হলে তো কথাই নেই। তাদের কোন নরককুণ্ড পার হতে হয়, তা তারাও জানে না।
জনগণের এই দুঃসময়ে তাদের জন্য শিক্ষক সমাজের পূর্ণ সমর্থন দেওয়া উচিত। দুর্ভাগ্য, তারা নিধিরাম সর্দার। তাই তাদের চুপচাপ থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে। আর নিধিভোগীরা নিরোর মতো বুঁদ হয়ে প্রাসাদ শীর্ষে বংশীবাদনে নির্বিকার! তাঁরা ভাবছেন, আপনি বাঁচলেই বাপের নাম। এই স্বার্থমগ্নদের রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : ‘স্বার্থমগ্ন যেজন বিমুখ/বৃহৎ জগৎ হতে সে কখনো শেখেনি বাঁচিতে।’ লেখা বাহুল্য, সমাজ চিরকালই এমনটি ছিল। তবে একদা কদাচিৎ কদর্যতা ঘটত। এখন কদাচিৎ ভালো উদ্যোগ নেওয়া হয়। শোনা যাচ্ছে, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। এটা নিঃসন্দেহে শুভ উদ্যোগ। জনগণ এদের স্বাগত জানাচ্ছে। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় এই শুভ উদ্যোগের সহযোগী যত শিগগির হবে ততই মঙ্গল। তা না হলে জনগণের ট্যাক্সের টাকা ভোগ করে, উল্টো জনগণকে পরিহাসকারীদের অশুভ প্রবণতা রোধে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। পঁচাত্তরের জাতীয় ট্র্যাজেডির কিছুদিন আগে নিধিভোগীদের সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ক্লিষ্ট জনগণ আবার সেই বজ্রকণ্ঠ শোনার জন্য উদগ্রীব। হায়, তা কি আর শোনা যাবে!
লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ
সূত্র: কালের কণ্ঠ