প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চলে সরকারের অর্থায়নে, এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষ তথা কৃষক ও শ্রমিকের ঘামঝরা অর্থে, নাগরিকদের ট্যাক্সে এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের আয়ের একটি অংশে। একজন গ্র্যাজুয়েট তৈরিতে সরকারের খরচ হয় ৯০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা। মর্যাদার মানদণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। সততার সঙ্গে গবেষণার পথ ধরেই এগোতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি তাঁদের নিজেদের জ্ঞানের গভীরতাও বৃদ্ধি পায়। একটি প্রচলিত কথা আছে—পুরাতন চাল ভাতে বাড়ে। সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের চাকরির বয়সসীমা ৬৫ বছর। অভিজ্ঞ শিক্ষকদের অবসর বলে কিছু নেই। কারণ অবসরের পরও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা সংস্থায় চাকরি করার সুযোগ মেলে।
স্বাধীন বাংলাদেশের গোড়ার দিকে অর্থাৎ ১৯৭২ সালে ছয়টি স্বনামধন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেই সময় শিক্ষার হার ছিল ২৬ শতাংশেরও নিচে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নামগন্ধও ছিল না। লোকসংখ্যা মাত্র সাড়ে সাত কোটি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নামে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সেই সময় ছিল না। প্রকৃতির অপার রহস্যের অন্তর্নিহিত তথ্য গবেষণা দ্বারা আহরণ ও উদ্ঘাটন করে মানব কল্যাণে তা প্রয়োগ করার কৌশলই হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৩৯টি। এর মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৯টি। দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে বেগবান করার লক্ষ্যে প্রতিটি জেলায় একটি করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরো ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা দেন।
তা ছাড়া রয়েছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়। মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশবলে গঠিত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। সব শ্রেণির বিশ্ববিদ্যালয় এফিলিয়েশন সাপেক্ষে নিজ নিজ বিধিমোতাবেক একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম চলে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য সিনিয়র প্রফেসর, মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, নীতিনির্ধারণী এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ প্রদান করা হয়ে থাকে মঞ্জুরি কমিশনে। উল্লেখ্য, মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে মেধা বিকাশের ওপর জোর দেয় তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার। ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদে বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস করার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন প্রদানের মধ্য দিয়ে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার দ্বার উন্মোচিত হয়।
একসময়ের মঙ্গাপীড়িত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত এবং শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা উত্তরবঙ্গের উন্নয়নের লক্ষ্যে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার প্রতি নজর দেয় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকার। এরই ফলে ১৯৯৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে চিহ্নিত করে। এ লক্ষ্যে দেশে ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং প্রথম পর্যায়ে ছয়টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা হয়। বর্তমানে শিক্ষা বিস্তার ও গবেষণায় ৯টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় যথারীতি চলমান রয়েছে।
উত্তরবঙ্গে অবস্থিত হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (হাবিপ্রবি), যেটি দিনাজপুর জেলা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তরে দিনাজপুর-রংপুর-ঢাকা এবং দিনাজপুর-পঞ্চগড় বিশ্বরোড সংলগ্ন রাস্তার পশ্চিম পার্শ্বে ৮৫ একর জায়গাজুড়ে। যেখানে গড়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন বেশ কয়েকটি অট্টালিকা, যার মধ্যে আটটি অনুষদ বিদ্যমান। এখানে ৪৩টি বিভাগের অধীনে স্নাতক পর্যায়ে ২২ প্রকার এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ৩১ প্রকারের ডিগ্রি প্রদান করা হয়ে থাকে। তা ছাড়া এমবিএ ৪ এবং পিএইচডি ১১ প্রকারের ডিগ্রি প্রদান করা হয়ে থাকে। বর্তমানে দেশি-বিদেশি ছাত্র-ছাত্রীর মোট সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার। স্নাতক পর্যায়ে সাতটি অনুষদের অধীনে চার বছর মেয়াদি (আট সেমিস্টার) এবং ভেটেরিনারি সায়েন্স (ডিভিএম) পাঁচ বছর মেয়াদি (১০ সেমিস্টার) পড়ে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি নিতে হয়।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক সংখ্যা ২৯৩ জন। আশা করা যায় এ বছরেই শিক্ষক সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়ে যাবে। মোট সাতটি ছাত্রাবাস, যার মধ্যে তিনটি ছাত্রীদের জন্য।
৮ জুলাই ২০০১ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে ৩৫ নম্বর আইন হিসেবে হাবিপ্রবি আইন পাস করা হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ১০ নম্বর ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে চ্যান্সেলর মহোদয় দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ কোনো ব্যক্তিকে চার বছর মেয়াদে ভাইস চ্যান্সেলর পদে নিয়োগ দান করেন। এ পর্যন্ত পালাক্রমে পাঁচজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করেন। সবাই অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ ও সুনামের সঙ্গে পালন করেন। বর্তমানে প্রফেসর ড. মু. আবুল কাসেম ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখ থেকে সুশৃঙ্খলভাবে প্রশাসনিক ও একাডেমিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যতিক্রমধর্মী কিছু কাজ হচ্ছে যেমন—শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অফিস ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান, গবেষণায় বিশেষ নজর দান, সেশন জট কমিয়ে আনা, অবকাঠামোর উন্নয়ন, যোগাযোগের জন্য নতুন বাস, মিনিবাস, মাইক্রোবাস ও অ্যাম্বুল্যান্স ক্রয়। ভেটেরিনারি চিকিৎসায় গ্রামগঞ্জে গিয়ে প্রাণীর চিকিৎসার স্বার্থে অ্যাম্বুলেটরি ক্লিনিক ও বাস ক্রয় করার উদ্যোগ গ্রহণ। মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থীদের গবেষণা ও কৃষকদের মধ্যে স্বল্পমূল্যে উন্নতমানের পোনা সরবরাহের লক্ষ্যে একটি হ্যাচারি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গ্র্যাজুয়েটদের চাকরি সন্ধানের নিমিত্তে ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
একটি বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠান ভালোভাবে চালিয়ে নিতে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সবার সততা, দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে উন্নয়নে সহযোগিতা করা। এ ব্যাপারে বর্তমান প্রশাসনের কোনো কমতি নেই বিধায় যথারীতি বিশ্ববিদ্যালয়টি এগিয়ে যাচ্ছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক, একাডেমিক ও গবেষণা সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে যেতে প্রত্যেক শিক্ষকের ক্যাম্পাসে অবস্থানের কোনো বিকল্প নেই। এ বিষয়টি সবাইকে গুরুত্বসহকারে অনুধাবন করতে হবে।
লেখক : চেয়ারম্যান ও ডিন, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ