সম্পদের বিবরণী নিয়ে গড়িমসি শীর্ষস্থানীয় সহায়ক বই প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানের - দৈনিকশিক্ষা

সম্পদের বিবরণী নিয়ে গড়িমসি শীর্ষস্থানীয় সহায়ক বই প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানের

রাকিব উদ্দিন |

গাইড ও সহায়ক বই বিক্রির শীর্ষে থাকা ২৭টি প্রকাশনী সংস্থার মধ্যে মাত্র ৫/৭টি প্রতিষ্ঠান তাদের সম্পদের বিবরণী জমা দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। দুদকের চিঠি পাওয়া বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পদের বিবরণী দিতে গড়িমসি করছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দুদকের চিঠি পায়নি বলেও দাবি করছে। তাছাড়া আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দুদকের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে।

অবৈধ গাইড ও সহায়ক বই বিক্রি করে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জনের অভিযোগে গত বছর বেশ কয়েকটি প্রকাশনী সংস্থার ওপর অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। এর অংশ হিসেবে গত ২২ জানুয়ারি প্রথমে পাঁচটি প্রকাশনী সংস্থার কাছে সম্পদের হিসেব চেয়ে নোটিশ দেয় সংস্থাটি। ওই নোটিশেই ২৭টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ ছিল। পরবর্তীতে আল ফাতাহ ও পপি প্রকাশনীসহ আরও ২২টি প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ পাঠায় দুদক।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নোটিশ পেয়ে ২৪ জানুয়ারি দুদকে সম্পদের বিররণী প্রদান করে লেকচার, পাঞ্জেরী, রয়েল সায়েন্টিফিক পাবলিকেশন্স কর্তৃপক্ষ। চিঠি পেয়েও দুদকের কাছে সম্পদের বিবরণী দেয়নি দীর্ঘদিন ধরে দেশব্যাপী নিষিদ্ধ নোট গাইড বইয়ের ব্যবসা করে আসা কাজল ব্রাদার্সের ‘অনুপম প্রকাশনী’। আর দুদকের নোটিশকে ‘এখতিয়ারবহির্ভূত’ আখ্যা দিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেছে জুপিটার পাবলিকেশন্স কর্তৃপক্ষ।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে লেকচার প্রকাশনীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফুল আলম  বলেন, ‘আমরা সরকারের প্রচলিত সব ধরনের নিয়মকানুন প্রতিপালন করেই ব্যবসা পরিচালনা করছি। ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দেই না। এজন্য দুদকের পক্ষ থেকে যেসব তথ্য চাওয়া হচ্ছে, তা যথাযথভাবে দেয়া হচ্ছে।’

জানা গেছে, বেশকিছু প্রকাশনী সংস্থা নোট বা সহায়ক বই ছাপা ও বাজারজাত করে বিপুল পরিমান অবৈধ অর্থ অর্জন করেছে বলে গত বছর একটি অভিযোগ পায় দুদক। এতে বলা হয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি), জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডসহ (এনসিটিবি) বিভিন্ন সরকারি দফতরের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায় সারাদেশে নোট-গাইড বই বিক্রি হচ্ছে।

ওই অভিযোগের ভিত্তিতেই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সম্পদের খোঁজে মাঠে নামে দুদক। দুদকের একজন উপ-পরিচালকের নেতৃত্বে একটি অনুসন্ধান টিমও গঠন করা হয়। এই টিম আকস্মিকভাবে রাজধানীর নীলক্ষেতের হযরত শাহজালাল মার্কেট, বাবুপুরা মার্কেট, বাকুশাহ মার্কেট, ইসলামীয়া মার্কেটের বিভিন্ন লাইব্রেরিতে অনুসন্ধান চালায়। এতে অভিযোগের সত্যতা পায়।

প্রাথমিক তদন্তে দুদক টিম দেখতে পায়, বাজারের প্রায় প্রতিটি দোকানে অননুমোদিত গাইড বইয়ের ছড়াছড়ি। দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত বিভিন্ন নামে বিভিন্ন কোম্পানির গাইড বই বিক্রি হচ্ছে।

এর মধ্যে অনুপম, নবদূত, রয়েল, আদিল, কম্পিউটার, ক্লাসিক, জননী, পপি, জ্ঞানগৃহ, মীম, মুন্নী, সুমন লাইব্রেরি, পারপেক্ট, স্বপ্নীল, তামান্না, বর্ণমালা, বই প্রকাশনী অন্যতম। এছাড়াও মিজান লাইব্রেরি, কাজল ব্রাদার্স, দি রয়েল সাইন্টেফিক পাবলিকেশন্স অবৈধভাবে নোট গাইড বই ছাপা ও বাজারজাত করছে।

এছাড়া জামায়াত-শিবির মালিকানাধীন বেশকিছু নোট-গাইড বই ও প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে পিস পাবলিকেশন, কামিয়াব গাইড ও প্রকাশনী, আল ফাতাহ ও আল ফালাহ্ গাইড, আধুনিক প্রকাশনী, সোনালী সোপান প্রকাশনী, তাছমিয়া পাবলিকেশন, শতাব্দী প্রকাশনী, ইসলামীক সেন্টার, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইসলামিক ন্যাট, প্রত্যয় প্রকাশনী, প্যান্টন প্রিন্টিং প্রেস, গ্লোবাল প্রিন্টিং এন্ড পাবলিকেশন নেটওয়ার্কস, চট্রগ্রামের মদিনা একাডেমি পাবলিকেশন অন্যতম।

ওই অভিযোগে বলা হয়, দেশে বিদ্যমান নোট বই (নিষিদ্ধকরণ আইন) ১৯৮০ (১৯৮০ সালের ১২নং আইন) থাকা সত্ত্বেও দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কিছু কর্মকর্তা নিয়মিত মাসোহারা নিয়ে এ সকল অবৈধ ব্যবসা পরিচালনায় সহযোগিতা করছেন। বেশ কয়েকটি প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধারদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়টিও অভিযোগপত্রে উল্লেখ রয়েছে।

এ ব্যাপারে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি পুঁথি নীলয় প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী শ্যামল পাল  বলেন, ‘ওই অভিযোগ পত্রটি আমরা পেয়েছি। এটি বেনামি চিঠি, বাকুশাহ মার্কেট থেকে করা হয়েছে। এর কোন ভিত্তি নেই। এরপরও যারা দুদকের চিঠি পেয়েছেন, তারা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।’

এদিকে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, ধারাবাহিকভাবে শিশুদের কাঁধে বইয়ের বোঝা বাড়ছে; সেই অনুযায়ী দক্ষ ও বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ পাচ্ছে না। আবার সৃজনশীল বিষয়ে শিক্ষার্থী দূরের কথা শিক্ষকরাও ঠিকমতো বুঝতে পারছে না। এছাড়া বছরে চারটি পাবলিক পরীক্ষা নেয়া ও এগুলোর খাতা মূল্যায়নসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে হয় শিক্ষকদের, যাতে শ্রেণি কার্যক্রম কমে যাচ্ছে। এর ফলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সহায়ক বইয়ের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

এনসিটিবি’র তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ শিক্ষাবর্ষে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মোট ৫৭৪টি বিষয়ের পাঠ্যবই ছাপানো হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমের ৩৩টি ও ইংরেজি ভার্সনের ২৩টি, ৬ষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমের ১০২টি ও ইংরেজি ভার্সনের ৬৫টি, এসএসসি’র (ভোকেশনাল) ট্রেড বই ৬১টি, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ব্রেইল বই ১০৯টি, শিক্ষক নির্দেশিকা (টিজি) ৫৬টি, মাদ্রাসার ইবতেদায়ীর ৩৬টি ও দাখিল স্তরের ৭৯টি এবং পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুর জন্য ১০টি বিষয়ের বই ছাপানো হয়েছে।

এ ব্যাপারে শিক্ষক-কর্মচারী সংগ্রামী ঐক্যজোটের প্রধান সমন্বয়কারী রাজধানীর সিন্ধান্ত হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম রনি  বলেন, ‘দেশের বেশির ভাগ স্কুল-কলেজেই বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নেই। অসংখ্য শিক্ষকের পদ শূন্য। সৃজনশীল বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেই, পর্যাপ্ত শিক্ষকও নেই। ছাত্রছাত্রীরা বেকায়দায় রয়েছে। ৭/৮ হাজার স্কুলের প্রায় এক লাখ শিক্ষকের বেতনভাতা নেই। আবার প্রতিবছর কারিকুলাম পরিবর্তন হচ্ছে; কিন্তু শিক্ষকদের কিছুই জানানো হচ্ছে না। এসব কারণেই খোলাবাজার থেকে সহায়ক বই কিনে পড়তে হচ্ছে। এই দায় শিক্ষা প্রশাসনের।’

দুদকের একজন কর্মকর্তা  জানান, নোট-গাইড নিষিদ্ধের আইন থাকা সত্ত্বেও কীভাবে সকল শ্রেণির নোট গাইড প্রকাশ্যে বাজারে বিক্রি হচ্ছে বিষয়টি খতিয়ে দেখছে দুদক টিম। পাশাপাশি এই ব্যবসার মাধ্যমে যে সকল প্রকাশনা সংস্থা অবৈধ সম্পদ অর্জন করছেন তাদের বিষয়ে অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

জানা গেছে, নোট বই প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে ১৯৮০ সালে একটি আইন করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০০৭ সালের ১০ ডিসেম্বর সরকারের অননুমোদিত নোট ও গাইড বই বাজারজাত বন্ধ করতে প্রয়োজনে মোবাইল কোর্টের সাহায্য নিতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেয়। এই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রয় সমিতির সভাপতি আবু তাহের ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। এতে বলা হয়, নোট বই নয়, গাইড বই প্রকাশ করে তা বাজারজাত করা হচ্ছে। রিট আবেদনকারীর যুক্তি খ-ন করে হাইকোর্ট একই বছরের ১৩ মার্চ ১৯৮০ সালের নোট বই নিষিদ্ধকরণ আইনের আওতায় নোট বইয়ের সঙ্গে গাইড বইও বাজারজাত ও বিক্রি নিষিদ্ধ করে মন্ত্রণালয়ের আদেশ বহাল রাখেন।

পরবর্তীতে আপিল বিভাগেও ওই আবেদন খারিজ হয়ে যায়। এরপর ২০০৯ সালের নভেম্বরে নোট-গাইড বই নিষিদ্ধ করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন আবু তাহের। সে সময় আপিল বিভাগের চেম্বার জজ হাইকোর্টের ওই আদেশ স্থগিত করেন। এতে নোট ও গাইড বই বাজারজাত ফের শুরু হয়। এ অবস্থায় এটর্নি জেনারেলের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের নভেম্বরেই আপিল বিভাগে বিষয়টির ওপর শুনানি হয়। শুনানি শেষে আপিল খারিজ করে দেয়া হয়।

সর্বোচ্চ আদালতের ওই সিদ্ধান্তের পর দেশে নোট বই ছাপা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর সহায়ক বইয়ের প্রকাশনায় নামেন প্রকাশকরা। সহায়ক বই প্রকাশে সহযোগিতা করছেন বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকরা। আবার সরকারি হাইস্কুল ও কলেজের বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞ শিক্ষকরাও বেনামে সহায়ক বই রচনা করছেন।

সূত্রঃ দৈনিক সংবাদ

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032918453216553