সরকারি কলেজের প্রদর্শকদের মর্যাদায় বৈষম্য কেন? - দৈনিকশিক্ষা

সরকারি কলেজের প্রদর্শকদের মর্যাদায় বৈষম্য কেন?

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

দেশের সরকারি কলেজসমূহে কর্মরত প্রদর্শকরা পদ মর্যাদার দিক থেকে চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। ফলে আর্থিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও মানসিক দিক থেকে তারা হীনমন্যতার মধ্যে আছেন।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন সরকারি কলেজে কর্মরত প্রদর্শক, শরীর চর্চা শিক্ষক এবং সরকারি হাই স্কুলের শিক্ষক-এই তিনটি পদ ১০ম গ্রেডের। তিনটি পদের বেতনস্কেল একই। তিনটি পদই সমমানের। কিন্তু, বর্তমানে শেষোক্ত দুটি পদ অর্থাৎ শরীর চর্চা শিক্ষক এবং সরকারি হাই স্কুলের সহকারী শিক্ষক দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড মর্যাদা লাভ করলেও প্রদর্শক পদটি তৃতীয় শ্রেণির নন-গেজেটেড পদ মর্যাদায় রাখা হয়েছে। ফলে সারা দেশের সরকারি কলেজসমূহে কর্মরত কয়েকশ প্রদর্শক মর্যাদার প্রশ্নে মনে কষ্ট নিয়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের নিয়োগ বিধিমালায় প্রদর্শক পদের কাম্য শিক্ষাগত যোগ্যতা (সংশ্লিষ্ট বিষয়সহ দ্বিতীয় শ্রেণির স্নাতক ডিগ্রি অথবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি) বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার শিক্ষাগত যোগ্যতার সমমান। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস রিক্রুটমেন্ট রুলস অনুসারে প্রদর্শক পদটি একটি পদোন্নতি যোগ্য পদ। এ পদ থেকে পদোন্নতি পেয়ে প্রদর্শকরা প্রভাষক পদে পদোন্নতি যোগ্য হবেন।

প্রসঙ্গত, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে এস.টি.বি.আর ১/এম/১২/৭৫/৯৮ তাং-১৪/০৫/১৯৭৫ স্মারকে কলেজ পর্যায়ের দুটি পদ শরীরচর্চা শিক্ষক ও প্রদর্শক এবং সরকারি হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষকের পদকে দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেট পদ মর্যাদা প্রদান করা হয়। জাতির জনকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর সেটি আর আলোর মুখ দেখতে পায়নি।

পরবর্তী সময়ে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষকদের একটি সমাবেশে বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জাতির জনকের সুযোগ্য তনয়া শেখ হাসিনা সরকারি হাই স্কুলের সহকারী শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির পদ মর্যাদার ঘোষণা দিলে তাঁর ঘোষণার তারিখ অর্থাৎ ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ মে থেকে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির পদ মর্যাদায় উন্নীত করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা কিংবা প্রজ্ঞাপনে কলেজের শরীরচর্চা শিক্ষক ও প্রদর্শকদের উল্লেখ না থাকায় প্রদর্শক ও শরীরচর্চা শিক্ষকদের পক্ষ থেকে পদ দুটিকে অনুরূপ দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড পদ মর্যাদায় উন্নীত করণের জন্য ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ মে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করা হয়।

এর প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যথাযথ প্রক্রিয়াশেষে গত ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিধি)-এর সভাপতিত্বে জনপ্রশাসন, শিক্ষা ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত সভায় সর্বসম্মতিক্রমে প্রদর্শক, সহকারী গ্রন্থাগারিক কাম ক্যাটালগার ও শরীরচর্চা শিক্ষক পদকে দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা দেবার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু, ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ডিসেম্বর শুধু শরীরচর্চা শিক্ষকের পদটিকে দ্বিতীয় শ্রেণির পদ মর্যাদায় উন্নীত করে গেজেট প্রকাশ করা হয়।

প্রদর্শক পদটি ১০ম বেতন গ্রেডের একটি পদ। এটিকে দ্বিতীয় শ্রেণির পদ মর্যাদায় উন্নীত করা হলে সরকারের অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন হয় না। প্রদর্শকরা সরাসরি শ্রেণি পাঠদান কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত। তারা বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকেন।

জাতীয় বেতনস্কেল-২০১৫ এর অনুচ্ছেদ ০৮-এ উল্লেখ আছে যে, সরকারি কর্মচারীরা শ্রেণি বিভাজনের বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তে বেতনস্কেল গ্রেডভিত্তিক পরিচিত হবেন। কিন্তু, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের দাপ্তরিক সকল নথিপত্রে গ্রেডভিত্তিক পরিচয়ের পরিবর্তে এখনো শ্রেণি প্রথা ব্যবহার করা হয়। মাউশি অধিদপ্তরের বিভিন্ন আদেশ ও পরিপত্রে প্রতিনিয়ত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির উল্লেখ দেখা যায়। ১০ম গ্রেডে বেতন পেলেও প্রদর্শক পদটিকে শ্রেণি বিভাজনের মধ্যে তৃতীয় শ্রেণি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অন্যান্য সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানে ১০ম গ্রেডের পদসমূহ দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা গণ্য হলেও একই গ্রেডের সরকারি কলেজের প্রদর্শকরা তৃতীয় শ্রেণির নন-গেজেটেট মর্যাদায় গণ্য হয়ে থাকেন।

সরকারি কর্ম কমিশন বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কিন্তু পদ স্বল্পতার কারণে ক্যাডার পদে সুপারিশপ্রাপ্ত নন এমন প্রার্থীদের আবেদনের ভিত্তিতে প্রথম শ্রেণি (গ্রেড-৯) ও দ্বিতীয় শ্রেণি (গ্রেড-১০, ১১ ও ১২) নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ প্রদানের জন্য সুপারিশ করে থাকে। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৪ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিধি-১ শাখা কোটা পদ্ধতি সংশোধন পরিপত্রে শ্রেণি বিভাজন হিসেবে ৯ম গ্রেড (পূর্বতন ১ম শ্রেণি) এবং ১০ম-১৩ তম গ্রেড (পূর্বতন ২য় শ্রেণি) উল্লেখ করেন।

২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ফেব্রুযারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিধি-১ শাখা সরকারি কর্মচারী নিয়োগ কর্তৃপক্ষ ও পদ্ধতি নির্ধারণ সংক্রান্ত প্রস্তাবটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা পূর্বক সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে কমিটি গঠনের গেজেটে বেতনগ্রেড ১৩-২০ (৩য় ও ৪র্থ শ্রেণি) হিসেবে উল্লেখ করা হয়। উল্লিখিত তিনটি সূত্রের আলোকে ১০ম গ্রেড কোনো অবস্থাতেই তৃতীয় শ্রেণি বলে বিবেচিত হতে পারে না। তাই প্রদর্শক পদটি একটি দ্বিতীয় শ্রেণির পদ।

বর্তমান জনবান্ধব সরকারের সময়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অন্তর্গত বিভাগ, দপ্তর, অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরের অনেক পদের বেতন স্কেল আপগ্রেড করে পদমর্যাদা উন্নীত করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা পদের কথা উল্লেখ করা যায়। উক্ত পদের বেতনস্কেল ও পদমর্যাদা উভয়ই বৃদ্ধি করা হয়েছে।

সচিবালয়সহ মাঠ পর্যায়ের সকল প্রশাসন কার্যালয়ে প্রধান সহকারী, উচ্চমান সহকারী, সাঁটলিপিকার, কম্পিউটার অপারেটর ও হিসাব রক্ষক প্রভৃতি পদগুলোকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদমর্যাদার বেতনস্কেল ১০ম গ্রেডে উন্নীত করা হয়েছে। প্রদর্শকদের বেতনগ্রেড-১০ম হওয়ায় তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদায় উন্নীত করা হলে নতুন করে বেতনস্কেল নির্ধারণের প্রয়োজন নেই।

এছাড়া, ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্তৃক অনুমোদিত Table of Organization and Equipment of Departments/Directorates and Sub-ordinate offices (phase-2)-এর Directorare General of Secondary and Higher Education, Education Division, Ministry of Education Summary of Manpower (Page-178) and Class-Wise Summary of Manpower-Departments (Sl-139, Page-256,257) অনুযায়ী প্রদর্শক (Demonstrator) পদটি দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদার সমান। কিন্তু, পরবর্তী সময়ে কেন প্রদর্শক পদটি তৃতীয় শ্রেণি হিসেবে উল্লেখ করা হয়- তা কারো বোধগম্য নয়। এখানে কোনও একটি চক্রের হাত থাকতে পারে। 

১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের এনাম কমিটির Organisational set up রিপোর্ট অনুসারে প্রদর্শকরা সরকারি কলেজের ‘টিচিং স্টাফ’ হিসেবে গণ্য হবেন। এছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড (প্রবিধানমালা-২০০৯) এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গেজেট মতে প্রদর্শক পদটি একটি শিক্ষক পদ। ব্যবহারিক শিক্ষার পাশাপাশি সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মাধ্যমে  প্রদর্শকরা বিজ্ঞান তথা শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন।

এমতাবস্থায় দেশের সরকারি কলেজসমূহের প্রদর্শকদের মধ্যে এক নিদারুণ হতাশা বিরাজ করছে। কর্মস্থলের হতাশা দূর করে সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করত প্রদর্শকদের মধ্যে ব্যাপক কর্ম চাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণ কেবল হাতে কলমে বিজ্ঞান শিক্ষার মাধ্যমেই  সম্ভব। আর এজন্য প্রদর্শকদের ব্যাপক কর্ম চাঞ্চল্য ও পদমর্যাদা বৃদ্ধি করা একান্ত অপরিহার্য। বিষয়টির সাথে যেহেতু কোনো আর্থিক প্রশ্ন জড়িত নয়, সেহেতু সরকারি কলেজের প্রদর্শকদের অনতি বিলম্বে গেজেট নোটিফিকেশন দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা দিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

লেখক : অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী, অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার সংবাদ বিশ্লেষক।

ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জবি ছাত্রীর আত্মহত্যা: শিক্ষক-শিক্ষার্থী বহিষ্কার - dainik shiksha ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জবি ছাত্রীর আত্মহত্যা: শিক্ষক-শিক্ষার্থী বহিষ্কার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জবি ছাত্রীর আত্মহত্যা: শিক্ষক-শিক্ষার্থী বহিষ্কার - dainik shiksha ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জবি ছাত্রীর আত্মহত্যা: শিক্ষক-শিক্ষার্থী বহিষ্কার অবন্তিকার আত্মহত্যা: সাতদিনের মধ্যে তদন্ত সম্পন্নের আশ্বাস জবি উপাচার্যের - dainik shiksha অবন্তিকার আত্মহত্যা: সাতদিনের মধ্যে তদন্ত সম্পন্নের আশ্বাস জবি উপাচার্যের হয়রানির প্রতিকার চেয়েও ফল পাননি অবন্তিকা, অভিযোগ মায়ের - dainik shiksha হয়রানির প্রতিকার চেয়েও ফল পাননি অবন্তিকা, অভিযোগ মায়ের নতুন শিক্ষাক্রম: শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট না পড়লে মিলছে না মূল্যায়ন - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম: শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট না পড়লে মিলছে না মূল্যায়ন মূল্যায়ন বুঝলেও নৈপুণ্য অ্যাপে চ্যালেঞ্জের মুখে শিক্ষকরা - dainik shiksha মূল্যায়ন বুঝলেও নৈপুণ্য অ্যাপে চ্যালেঞ্জের মুখে শিক্ষকরা ‘পড়তে ও লিখতে’ শেখা প্রকল্প কেনো - dainik shiksha ‘পড়তে ও লিখতে’ শেখা প্রকল্প কেনো please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0044839382171631