সরকারি চাকরিতে প্রবেশ ও অবসর দুই দিকেই বয়স বাড়ানোর চাপ রয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর। আর বয়স্ক ও মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মচারীদের দাবি অবসরের বয়স বাড়ানোর। এ দুটির কোনোটিতেই সরকার আপাতত সায় দিচ্ছে না।
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সাধারণ বয়সসীমা ৩০ বছর, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের ক্ষেত্রে ৩২ বছর। সাধারণ কর্মচারীদের চাকরি থেকে অবসরের বয়সসীমা ৫৯ বছর। মুক্তিযোদ্ধাদের অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ৬৫, বিচারপতিরা ৬৭ বছর বয়সে অবসরে যাওয়ার সুবিধা পাচ্ছেন।
গত সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর আন্দোলনে নেমেছিল সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ করার সুপারিশ করে। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছিল। অন্যদিকে হাইকোর্ট থেকে মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মচারীদের অবসরের বয়স বাড়ানোরও একটি নির্দেশনা ছিল।
ওই নির্দেশনার ফলে বয়স্ক সরকারি কর্মচারীরা আশা করেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স বাড়ালে তাদের অবসরে যাওয়ার সীমাও বাড়াবে সরকার। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স বাড়ানোর হাইকোর্টের নির্দেশনা অবৈধ ঘোষণা করে আপিল বিভাগ। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স না বাড়ানোয় সাধারণ কর্মচারীদের অবসরে যাওয়ার বয়সও বাড়েনি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর বিষয়ে প্রথম দিকে সরকার কিছুটা নমনীয় ছিল। কিন্তু সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) থেকে এসংক্রান্ত তথ্য পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। পিএসসির তথ্য অনুযায়ী ৩৫, ৩৬ ও ৩৭তম—এই তিনটি বিসিএস পরীক্ষায় ২৯ বছরের বেশি চাকরিপ্রার্থীদের উত্তীর্ণের সংখ্যা শতকরা ২.৪৩ জন। এই হিসাব পাওয়ার পর চাকরিতে প্রবেশের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী নাকচ করে দেন।
পিএসসির তথ্য : ৩৫তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২১ থেকে ২৩ বছরের চাকরিপ্রার্থীরা চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন ১২.৩৮ শতাংশ। ২৩ থেকে ২৫ বছরের চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন ৪০.১৭ শতাংশ। ২৫ থেকে ২৭ বছরের প্রার্থীরা চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন ৩০.২৯ শতাংশ। ২৭-২৯ বছরের প্রার্থীরা চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন ১৩.১৭ শতাংশ।
আর ২৯ বছরের বেশি বয়সের প্রার্থীরা চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন মাত্র ৩.৪৫ শতাংশ। ৩৬তম বিসিএসে ২১ থেকে ২৩ বছরের চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে ৯.৬৪ শতাংশ, ২৩-২৫ বছরের চূড়ান্ত উত্তীর্ণ ৩৭.৪৫ শতাংশ, ২৫-২৭ বছরের চূড়ান্ত উত্তীর্ণ ৩৪.৭৮ শতাংশ, ২৭ থেকে ২৯ বছরের উত্তীর্ণ ১৪.৮৯ শতাংশ, আর ২৯ বছরের বেশি বয়সের চূড়ান্ত উত্তীর্ণ মাত্র ৩.২৩ শতাংশ।
৩৭তম বিসিএসে ২১ থেকে ২৩ বছরের চাকরি প্রার্থীরা নিয়োগ পেয়েছেন ২৫.১৯ শতাংশ, ২৩-২৫ বছরের পেয়েছেন ৪৩.৬৫ শতাংশ, ২৫-২৭ বছরের ২৩.৩৫ শতাংশ, ২৭ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে ৭.২০ শতাংশ, আর ২৯ বছরের বেশি বয়সের চূড়ান্ত মনোনয়ন পেয়েছেন মাত্র ০.৬১ শতাংশ।
পিএসসির চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক বলেন, ‘বিসিএসে ২৯ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে চূড়ান্ত উত্তীর্ণের সংখ্যা খুবই নগণ্য। তবে সরকার চাইলে সব ক্ষেত্রেই বয়স বাড়াতে বা কমাতে পারে।’
বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির মুখপাত্র ইমতিয়াজ হোসেন বলেন, ‘বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও ৩০ বছর বয়সীদের চাকরিতে নিতে চায় না। তাই সরকারি চাকরির বয়সটা বাড়ালে তরুণরা উপকৃত হবে।’
প্রবেশ-অবসর : বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যাত্রার শুরুতে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ছিল ২৭ আর অবসরে যাওয়ার বয়স ছিল ৫৭ বছর। স্বৈরশাসকের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজটের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ বছর করা হলেও অবসর ৫৭ বছরই থাকে।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযোদ্ধা কর্মচারীদের অবসরে যাওয়ার বয়স ৬০ এবং সাধারণ কর্মচারীদের অবসরে যাওয়ার বয়স ৫৯ বছর করা হয়। তখন থেকে শিক্ষার্থীরা চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর দাবি তোলে। অন্যদিকে বয়স্ক কর্মচারীদের দাবি, চাকরিতে প্রবেশের বয়স যখন ৩০ বছর করা হয় তখনই অবসরে যাওয়ার বয়স ৬০ বছর করা যৌক্তিক ছিল। ফলে এখন অবসরে যাওয়ার বয়স অন্তত এক বছর বাড়ানোটা যৌক্তিক।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘মানুষের গড় আয়ু বাড়ায় চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরে যাওয়ার সীমাও কিছুটা বাড়ানো যেতে পারে। তবে সেটা এক বছরের বেশি হওয়া উচিত হবে না।’
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরে যাওয়র বয়স বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা আপাতত সরকারের নেই।’