‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ওপারেতে যত সুখ আমার বিশ্বাস।’ কথাটির অর্থ যে যেমনই বুঝুক বেসরকারি চাকরিজীবীরা কিন্তু সরকারি চাকরিজীবীদের বেলায় বললে কোনো ভুল হবে না। বাংলাদেশ একটি নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ। এখানে পড়াশোনার মূল লক্ষ্যই হলো কর্মসংস্থান। চাকরি বলতে এখানে সরকারি ও বেসরকারি এই দুই সেক্টরের চাকরিকেই বোঝানো হয়। একটা সময় ছিল যখন মেধাবী তরুণরা সরকারি চাকরি বাদ দিয়ে বেসরকারি চাকরির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। প্রতিভার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কম সময়ে বেতন বাড়ার আশা, আত্মবিকাশের সুযোগ, দ্রুত পদোন্নতি ইত্যাদি ছিল এর মূল কারণ। এভাবে চলছিল বেশ কয়েক বছর। কিন্তু এত সব সুবিধা কি সব কোম্পানি দেয়? আমাদের দেশে বড় কোম্পানিগুলোতে হাতেগোনা কয়েকজন উচ্চ পদের কর্মকর্তা থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় বড় পদগুলো দখল করে আছেন বিদেশিরা। এদের আবার সুযোগ-সুবিধাও অনেক বেশি। তাদের আরাম-আয়েশে কাজ করার জন্য ধাপে ধাপে সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে যথাযথ কর্তৃপক্ষ সর্বদা তৎপর। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশি শ্রমিক, কর্মকর্তাদের বেলায় এ ক্ষেত্রে কেন উল্টো নীতি? এমন আশা নিয়ে এরাও যার যার দায়িত্ব থেকে ঘাম ঝরাচ্ছেন। কিন্তু তাদের বেলায় নেই কর্তাদের কোন সুদৃষ্টি? নেই সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর কোন প্রবণতা। এরা মরুক বা বাঁচুক তাতে কিছু যায় আসে না, দিন-রাত পরিশ্রম করে প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানিকে আকাশে তুলে দিক এটাই যেন মালিক পক্ষের প্রত্যাশা। কারণে-অকারণে সামান্য ভুল-ত্রুটিতে চোখের নিমিষেই চাকরি চলে যায়। নেই তাদের কোনো জব সিকিউরিটি। এমনকি একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একজন সিইও বা এমডিরও চাকরির নিশ্চয়তা নেই। অন্যদিকে সরকারি একজন পিয়নেরও সেই নিশ্চয়তা রয়েছে। সোমবার (৩০ ডিসেম্বর) জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, অন্যদিকে সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে প্রবেশে ৩০ বছরের যে সীমাবদ্ধ নীতি সেটাও এখানে বিরাট সমস্যা যা বিশ্বের অন্য কোনো দেশে নেই। ফলে পড়ালেখা শেষ করে দ্রুতই বয়স শেষ হয়ে যাওয়ায় তরুণরা হতাশায় ভুগছেন। প্রতিনিয়ত বাড়ছে বেকারত্ব। সর্বশেষ বেতন কাঠামো অনুযায়ী সরকারি চাকরিজীবীদের কাজের প্রতি মনোযোগ বাড়াতে, ঘুষ-দুর্নীতি কমাতে বেতন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ হারে। সেই সঙ্গে বেড়েছে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে এতসব সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পরও ঘুষ-দুর্নীতি না কমে উল্টো তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। মানুষ যত পায় ততই চায়, আর এখানেও তাই হয়েছে। তাহলে তো স্বাভাবিকভাবে তরুণরা সরকারি চাকরির প্রতি আকৃষ্ট হবেই। কারণ এখানে একদিকে আছে জব সিকিউরিটি অন্যদিকে সামাজিক মর্যাদা, যা ভালো পরিবারে বিয়ের ক্ষেত্রে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া রয়েছে গাড়ি ও বাড়ির ঋণ, মোবাইল কেনার জন্য টাকা, নানা রকম ভাতা, পর্যাপ্ত ছুটি, পেনশন সুবিধা, গ্রেফতারে সরকারের অনুমতি ইত্যাদি। তাই তরুণরা উচ্চ শিক্ষিত হয়ে একটা পিয়নের চাকরির জন্য পর্যন্ত লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েও চাকরি পেতে আগ্রহী। কারণ সরকারি চাকরি এখন সোনার হরিণ। দেশে সরকারি খাতে চাকরিজীবী ১৫ লাখেরও বেশি (সূত্র : অর্থ মন্ত্রণালয়), যা কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ ভাগ। তারা সবাই পেনশন সুবিধা পান।
অন্যদিকে, বেসরকারি খাতের ৯৫ শতাংশের মধ্যে মাত্র ৮ ভাগ ফরমাল বা আনুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের কোনো পেনশন সুবিধা নেই। সরকারি খাতের নিম্ন থেকে উচ্চ স্তরের কর্মকর্তারা আনুপাতিক হারে বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেলেও ব্যাংক বা বহুজাতিক কোম্পানি ছাড়া বেসরকারি খাতে বেতন-ভাতার ক্ষেত্রে স্তরভেদে সুযোগ-সুবিধার আনুপাতিক হারে তারতম্য পরিলক্ষিত হয় । এককভাবে পোশাক খাতেই রয়েছেন বিভিন্ন পদে প্রায় ৪০ লাখেরও বেশি চাকরিজীবী। পরিতাপের আরেকটি বিষয় হলো, কোম্পানি কর্তারা যেমন খুশি তেমন বেতন দিয়ে থাকেন। এই বেতন নির্ধারণের যেন কোনো নিয়ম-নীতি নেই। এদের হয়ে কথা বলার জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেই কোনো ইউনিয়ন। প্রতিটি বিষয়েরই সঠিক বিচারের একটা মানদণ্ড থাকা উচিত। কাক ডাকা ভোরে এই সব নিচু ও মাঝারি পদের কর্মীরা বের হয়ে সকাল-সন্ধ্যা কাজ করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাভবান করে দিচ্ছেন, দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। অথচ তারাই আবার বঞ্চিত হচ্ছেন। পোশাক-আশাকে নেহাত সুখী ও ভদ্র দেখালেও অদেখা শত কষ্ট, না পাওয়ার যন্ত্রণা ও অনিশ্চয়তার যন্ত্রণা এদের কুরে কুরে খায়। বাজারের নিয়মানুযায়ী দক্ষতা বেশি হলে বেতনও বেশি হয়। যদি তাই হয় তাহলে বাজার অর্থনীতিতে যারা বেশি অবদান রাখছেন তাদের বেতন বেশি হওয়া উচিত। তবে বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিটি খাতের ন্যূনতম মজুরি ও বেতন থাকা উচিত। একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর মূল্যস্ফীতির সঙ্গে ভারসাম্য রেখে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি দরকার। অন্যথায় বৈষম্য মাত্রা ছাড়া হয়ে যাবে। এদের যেমন নেই পেনশন সুবিধা তেমনি নেই চাকরির নিশ্চয়তা, ঈদ ছাড়া নেই তেমন কোনো ছুটি। একটা বয়সে হঠাৎ করে কারও চাকরি চলে গেলে তিনি সন্তান-সন্তুতি নিয়ে খালি হাতে যাবেন কোথায়? তাদের জন্য অন্তত প্রভিডেন্ট ফান্ড, বীমা, গ্র্যাচুইটিসহ অন্যান্য সুবিধা থাকা উচিত।
সরকারের উচিত বেসরকারি চাকরিজীবীদের চাকরি ও ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য একটা নীতিমালা প্রণয়ন করা। যেখানে একটা নির্দিষ্ট সময় পর আবেদনের ভিত্তিতে কর্মরত সব কর্মকর্তা-কর্মচারী স্থায়ী হয়ে যাবেন। অবসরের আগে সামান্য ভুল-ত্রুটিতে কারও চাকরি চলে যাবে না। বরং কোনো অপরাধের কারণে বিধি অনুযায়ী একটা শাস্তি প্রদান করা যেতে পারে। এ ছাড়া সরকারি পরিচালনায় একটা ফান্ড থাকবে যেখানে মাসিক স্থায়ী চাকরিজীবীদের (পদ ও বেতন অনুযায়ী) বেতনের ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রদেয় একটা অংশ জমা হবে। এই ফান্ড সরকারের এই দেখভাল সংক্রান্ত কাজের ব্যয়ভার বহন করবে। আর অবসরকালীন সময়ে এখানে জমাকৃত অর্থের সঙ্গে সুদের একটা অংশসহ সবাই পাবে। তখন দেখা যাবে লাখ লাখ বেসরকারি চাকরিজীবী এই নীতিমালার আওতায় চলে আসবেন। সবাই নতুন করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবেন। সরকারিতে অনেকটা চাপ কমবে আর চাকরিতে প্রবেশে তখন বেসরকারি ক্ষেত্রও অনেকটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠবে বলে বিশ্বাস করি।
লেখক : নাজমুল হোসেন, প্রকৌশলী।