দৌলতপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে সামান্য এগিয়ে ডান দিকে বাঁক নিলেই পুরনো যশোর রোড। তা ধরে বিএল কলেজ ক্যাম্পাসে যেতে বাঁয়ে পড়ে শিক্ষা প্রকৌশল দপ্তরের অফিস। এটি বিএল কলেজের জমির ওপর অবস্থিত। কেন, কিভাবে, কোন সমঝোতার ভিত্তিতে কলেজের জমিতে শিক্ষা বিভাগেরই আরেকটি অফিস গড়ে উঠেছে, তা জানা যায়নি। তবে এটুকু জানা গেছে যে ওই জমির খাজনা এখনো কলেজ কর্তৃপক্ষই পরিশোধ করে।
সরকারি অফিসের পাশাপাশি অনেক বেসরকারি স্থাপনা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও রয়েছে বিএল কলেজের জমিতে। কিন্তু দখলদাররা প্রভাবশালী হওয়ায় ওই জমি দখলমুক্ত করতে কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগ নেই। ২৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক কালের কণ্ঠের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।
কেউ কেউ দাবি করেন, খুলনা-যশোর রেললাইনের পশ্চিম পাশেও বিএল কলেজের জমি রয়েছে, যা অনেক আগেই বেহাত হয়ে গেছে। আর রেললাইনের পূর্বপারে কলেজের জমি থাকার কথা কেউ অস্বীকার করে না। তবে সেসবের বেশির ভাগই দীর্ঘদিন ধরে নানাজনের দখলে আছে। তাৎপর্যের বিষয় হলো, কলেজ কর্তৃপক্ষও প্রতিষ্ঠানের জমির সীমানা সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখে না।
কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর কে এম আলমগীর হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘কলেজের পূর্ব পাশের বেশ কিছু জমি উদ্ধার করে সীমানাপ্রাচীর দেওয়া হয়েছে। ওই জমি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের আওতায় ছিল। এর বাইরেও বেহাত হয়ে থাকা কলেজের জমি উদ্ধারে চেষ্টা চলছে।’ অধ্যক্ষ এ-ও জানান, কলেজের জমির কোনো মাপজোখ করা হয়নি। ফলে কতটা জমি কলেজের দখলে আছে আর কতটা বেহাত হয়ে আছে, তা পরিষ্কার নয়।
জানা যায়, বিএল কলেজের যাত্রা শুরু হয়েছিল দুই একর জমি নিয়ে। বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার ঘাটভোগের জমিদার ত্রৈলক্যনাথ চট্টোপাধ্যায় এই জমি কিনে দেন। পরবর্তী সময় হাজী মুহম্মদ মুহসীন ট্রাস্ট সৈয়দপুর এস্টেটের ৪০ একর জমি এই প্রতিষ্ঠানে দান করে। সে হিসাবে কলেজের মোট জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪২ একর। অবশ্য কলেজের বর্তমান কাগজপত্রে জমির পরিমাণ ৪১ একর ৫ শতাংশ।
একাধিক শিক্ষক জানান, প্রকৃতপক্ষে সমস্যার শুরু হয় কলেজটি সরকারি করার সময় থেকে। ওই সময় কলেজের সীমানা চিহ্নিত করে প্রাচীর দেওয়া থাকলে নিজেদের জমির ওপর কলেজের কর্তৃত্ব থাকত। কিন্তু কোনো না কোনোভাবে বিষয়টি উপেক্ষিত হওয়ায় মূল ক্যাম্পাসের বাইরের বেশ কিছু জমি বেহাত হয়ে গেছে। আর দীর্ঘদিন বেহাত হয়ে থাকায় ওই জমিতে দখলদাররা এক ধরনের স্বত্ব প্রতিষ্ঠা করে বসেছে। আর কলেজ কর্তৃপক্ষও বেহাত হওয়া জমি নিয়ে দখলদারদের সঙ্গে বিরোধে জড়াতে চায়নি।
কলেজের মূল ক্যাম্পাসের মধ্যে রয়েছে একটি প্রশাসনিক ভবন, চারটি একাডেমিক ভবন (কলা, জড়বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ও ব্যবসায় প্রশাসন), নতুন একটি একাডেমিক ভবন (দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনা কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় ও চতুর্থ তলা), চারটি সরকারি ভবন (মিলনায়তন, কমন রুম, ছাত্রসংসদ ও ব্যাংক) ও অধ্যক্ষের বাসভবন। আরো আছে ছাত্রাবাস, লাইব্রেরি ভবন, মসজিদ ইত্যাদি।
কলেজের পশ্চিম এবং উত্তর-পশ্চিম পাশে সীমানাপ্রাচীর রয়েছে। তবে এটিকে মূল ক্যাম্পাসের সীমানাপ্রাচীর বলা হয়। কারণ এর বাইরেও কলেজের অনেক জমি রয়েছে। উত্তর-পশ্চিম কোণে এবং ভৈরব নদের পার ধরে কলেজের জমিতে দীর্ঘদিন ধরেই ইট-বালুসহ নানা ব্যবসার কারবার ফেঁদে বসেছে দখলদাররা। এর বেশির ভাগই স্থানীয় এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় কলেজ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে বরাবরই উদাসীন থেকেছে। কলেজের পূর্ব দিকে আগে সীমানাপ্রাচীর ছিল না, বর্তমানে দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণেও সীমানাপ্রাচীর আছে।
একাধিক শিক্ষক জানান, কলেজের ক্যাম্পাসও একসময় বহিরাগতদের দখলে ছিল। তবে সম্প্রতি অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে বহিরাগতদের আড্ডা নেই। মোটরসাইকেল, সাইকেল নিয়েও কেউ প্রবেশ করতে পারে না। পুরো ক্যাম্পাস ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে।
অধ্যক্ষ প্রফেসর কে এম আলমগীর হোসেন বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অতীতে অনেক গুণী মানুষ বেরিয়ে গেছেন। সেই ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে চেষ্টা করে যাচ্ছি। কলেজে শিক্ষার পরিবেশ আরো উন্নত করার ব্যাপারে আমি আশাবাদী।’
এই কলেজে পড়িয়েছেন ঐতিহাসিক-গবেষক সতীশ চন্দ্র মিত্র ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর মতো গুণীরা। শিক্ষার্থী ছিলেন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের মতো ব্যক্তিত্ব। তবে উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে এখানে গবেষণা কার্যক্রম নেই বললেই চলে। শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের সৃষ্টিশীলতার চর্চা হিসেবে নিয়মিত কোনো প্রকাশনাও নেই। তবে ১১৭ বছরের কলেজ জীবনের ইতিহাসে এবারই প্রথম একটি আন্তর্জাতিক মানের জার্নাল প্রকাশিত হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষক বলেন, কলেজের পরিবেশ উন্নত হচ্ছে, জার্নালও প্রকাশিত হচ্ছে। তবে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মুখ্য উদ্দেশ্য পঠন-পাঠনের বিষয়টি এখানে অবহেলিত। অবশ্য এ জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম-নীতিও খানিকটা দায়ী।
এ ব্যাপারে কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর শরীফ আতিক উজ্জামান দাবি করেন, ‘শুধু দৃশ্যমান পরিবর্তন নয়, কলেজে শিক্ষা কার্যক্রম আরো উন্নত করতে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি।’