সরকারি মাধ্যমিকের সহকারী শিক্ষকদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দেয়া হোক - দৈনিকশিক্ষা

সরকারি মাধ্যমিকের সহকারী শিক্ষকদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দেয়া হোক

খালিদ বিন ওয়ালিদ |

শিক্ষা কাঠামোর ২য় স্তর মাধ্যমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষার পরবর্তী এবং উচ্চ শিক্ষার পূর্ববর্তী স্তরটি মাধ্যমিক শিক্ষা নামে পরিচিত। শিক্ষার্থীদের গড়ে ওঠার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সময় হলো বয়ঃসন্ধিকাল। আর বয়সসীমা অনুযায়ী (১২-১৯) মাধ্যমিক শিক্ষা হলো বয়ঃসন্ধিকালের শিক্ষা। সুতরাং, মানবজীবনে এই শিক্ষাস্তরের গুরুত্ব সর্বাধিক।    

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য এখন পর্যন্ত আলাদা ও স্বতন্ত্র কোনো অধিদপ্তর গড়ে ওঠেনি। এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাস্তর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের অধীনে মুমূর্ষু অবস্থায় চলছে। সরকারি মাধ্যমিকের সহকারী শিক্ষক পদটির সমগ্রেড বা তার নিচের গ্রেডের অন্যান্য দপ্তরের যে পদগুলো ছিল সেগুলোর প্রায় সব পদ বর্তমানে প্রথম শ্রেণির মর্যাদাপ্রাপ্ত। অথচ শিক্ষক সমাজের হৃদযন্ত্র সরকারি মাধ্যমিকের সহকারী শিক্ষক পদটি আজও ২য় শ্রেণির! বর্তমানে শিক্ষক সমাজের প্রাণের দাবি হলো এই পদটিকে প্রথম শ্রেণির গেজেটেড মর্যাদা দেয়া হোক।

এই দাবির স্বপক্ষে কিছু যুক্তি উল্লেখ করা হলো: 

৯ম গ্রেডের অন্যান্য সরকারি চাকরির এন্ট্রি পদে যে শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয়, মাধ্যমিকের সহকারী শিক্ষকের ক্ষেত্রেও অনুরূপ যোগ্যতা চাওয়া হয়। উপরন্তু নিয়োগের ৫ বছরের মধ্যে বিএড ডিগ্রি বাধ্যতামূলক। 

শিক্ষকের মর্যাদা নিশ্চিতকরণে এই পদটিকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ২ মে ২য় শ্রেণির মর্যাদা দিয়েছিলেন এবং তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয় ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ মে ২য় শ্রেণি ঘোষণা করেছিল। যে পদটি স্বাধীনতার পরপরই ২য় শ্রেণির মর্যাদা পেয়েছিল, এত দীর্ঘ সময় পার হয়ে এই পদের কর্মপরিধি, প্রবেশের যোগ্যতা বাড়লেও মর্যাদা বাড়েনি। অথচ আগে যেসব পদ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকের করেসপন্ডিং পোস্ট/পরস্পর বদলিযোগ্য পদ ছিল, (প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সৃষ্টির আগে) সেগুলো অনেক আগেই প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়েছে। অথচ শিক্ষাগুরুর মর্যাদা নিশ্চিতে শিক্ষকদেরই আগে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করা উচিত ছিল। 

বর্তমান প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে থানা শিক্ষা অফিসার (TEO) ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে পে-স্কেলে সরকারি মাধ্যমিকের সহকারী শিক্ষকদের নিচের ধাপের চাকরিজীবী ছিল, ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে সমমানের হয় এবং ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত হয়।
TEO, PTI Instructor এবং সরকারি মাধ্যমিকের সহকারী শিক্ষক এই তিনপদে একই পরীক্ষায় নিয়োগ হতো এবং এগুলো পরস্পর বদলিযোগ্য পোস্ট ছিল। এখন TEO Ges PTI Instructor পদ দুটিই ৯ম গ্রেডে।  

প্রাথমিক প্রধান শিক্ষককে ১০ গ্রেডে এনে সহকারী শিক্ষকদের তাদের পরের গ্রেডে আনার প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন হওয়ার পথে। সরকারি হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক ও সহকারীদের মধ্যে মর্যাদা ও অর্থগত পার্থক্য আকাশ পাতাল। 

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এবং মাধ্যমিক শিক্ষা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করা হয়েছে। বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকার শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে কয়েকটি সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে উচ্চ মাধ্যমিক চালু হয় এবং পর্যায়ক্রমে অন্য স্কুলগুলোতেও চালু হবে। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকগণ ২য় শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে অনেকটাই বেমানান। 

২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ২ নভেম্বর শিক্ষকদের ৮ বছর চাকরির মেয়াদ পূর্ণ হলে মোট শিক্ষকের ৫০ শতাংশকে ৯ম গ্রেডে উন্নীত করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সরকারি মাধ্যমিকে সাকল্যে শিক্ষক আছেন ১০ হাজারের কিছু বেশি। ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ৫০০০ হাজার চলে গেলে আর বাকি থাকবে পাঁচ ছয় হাজারের মতো। সুতরাং সবাইকে একযোগে ৯ম গ্রেডে নেয়া তেমন বিরাট মহাযজ্ঞের কোনো কাজ নয়। সরকারি প্রাথমিকের লাখ লাখ শিক্ষককে ১৪ থেকে ১১ গ্রেডে এবং লক্ষাধিক প্রধান শিক্ষককে ১২ থেকে ১০ গ্রেডে আনতে যে অর্থ ব্যয় হবে সে তুলনায় পাঁচ ছয় হাজার শিক্ষককে ১০ম থেকে ৯ম গ্রেডে নিতে যৎসামান্য খরচ হবে বললেই চলে।   

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ বাস্তবায়ন করতে হলে সবার আগে শিক্ষকদের স্বতঃস্ফূর্ত কর্যক্রম দরকার। শিক্ষকরা যদি নিজেদের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে দেখেন তখন তারা হীনম্মন্যতায় না ভুগে দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ করবে।   
সরকারি মাধ্যমিকের বেশিরভাগ শিক্ষক সরকারি কর্মকমিশনের সুপারিশে নিয়োগপ্রাপ্ত। এর মধ্যে একটা বৃহৎ অংশ বিসিএস নন-ক্যাডার। এই শিক্ষকরা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি পালনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। 

সরকারি মাধ্যমিকের শিক্ষকরা দেশের সবচাইতে বড় দুটি পাবলিক পরীক্ষার (জেএসসি ও এসএসসি) প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, পরীক্ষক ও প্রত্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। সুতরাং, সরকারি মাধ্যমিকের শিক্ষকরা দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ স্তরের অভিভাবক।

শুধুমাত্র শিক্ষকদের কাজের পরিধি বিবেচনায় নয় বরং এই পেশার মহত্ত্ব বিবেচনায় শিক্ষকদের যথাযথ সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে এই পদকে ৯ম গ্রেডে নেয়া সময়ের দাবি।

এছাড়াও, এই পদটি ২য় শ্রেণির হওয়াতে সরকারি মাধ্যমিকের শিক্ষকগণ বিদেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণ থেকে বঞ্চিত হন। শিক্ষা প্রশাসনের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তারাই এই সুবিধাগুলো ভোগ করেন। অথচ প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য দেশের কারিকুলাম সম্পর্কে অবগত হওয়া দরকার শিক্ষকদের। 

প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকের মর্যাদাদানে আমাদের সামনে একজন দৃষ্টান্ত, শিক্ষক জাতি আশা করে বিষয়টি তিনি সবিশেষ গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবেন। 

শিক্ষকের মর্যাদা বিষয়ক ইউনেস্কো ও আইএলও সনদ একটি আন্তর্জাতিক সনদ, যা শিক্ষকের মর্যাদা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) যৌথভাবে তৈরি করে। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ৫ই অক্টোবরে ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত বিশেষ আন্তরাষ্ট্রীয় সম্মেলনে সনদটি গৃহীত হয়। 

এটি শিক্ষকের অধিকার, কর্তব্য ও মর্যাদা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় প্রণীত ও স্বীকৃত প্রথম ঐতিহাসিক সনদ। সনদটি শিক্ষার অগ্রগতি, মানবজাতির ক্রমোন্নতি এবং আধুনিক সমাজের বিকাশ সাধনে শিক্ষক সমপ্রদায়ের অপরিহার্য ভূমিকা ও অবদানের কথা জোরের সঙ্গে ঘোষণা করে এবং শিক্ষকরা যাতে এসব ভূমিকা পালনের জন্য উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা ভোগ করতে পারেন তা সুনিশ্চিত করার অঙ্গীকার ঘোষণা করছে। 

এখানে অন্য পেশাজীবীর তুলনায় শিক্ষকদের কাজকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলা হয়েছে এবং অন্য পেশার তুলনায় পারিশ্রমিক ও মর্যাদা অসামঞ্জস্যপূর্ণ হলে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ করে শিক্ষকের মর্যাদা নিশ্চিতের কথা জোর দিয়ে বলা হয়েছে।

এই ধারাটি সম্পর্কে আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে একটি জাতির সার্বিক অগ্রগতির জন্য একটি দায়িত্বশীল ও দক্ষ চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, সামরিক পেশাজীবী শ্রেণী গড়ে তোলার বিকল্প নেই। যা বাস্তবায়নে শিক্ষকরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। তাই সর্বাগ্রে শিক্ষকদের মর্যাদা নিশ্চিত জরুরি। 

সনদে বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে যেসব দেশে শিক্ষক সরকারি চাকরির বিধিমালায় চাকরিরত, তাদের বিষয়ে বিশেষভাবে বিবেচনার কথা ঘোষিত হয়েছে। যদি শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা নিশ্চত না হয় তাহলে শিক্ষকদের মর্যাদা নিশ্চিতে প্রয়োজনে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। সনদটি আন্তর্জাতিক সমঝোতা দলিল হিসেবে পরিগণিত। এই সনদের প্রতি যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করা প্রতিটি দেশের সরকারের নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করা হয়।

তাই সার্বিক বিবেচনায় সরকারি মাধ্যমিকের সহকারী শিক্ষক পদটি প্রথম শ্রেণির গেজেটেড মর্যাদার যোগ্য দাবিদার।   

 

সৌজন্যে: মানবজমিন

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0041890144348145