সরকারি স্কুলে ৩টি বই, বেসরকারিতে ১৩টি! - দৈনিকশিক্ষা

সরকারি স্কুলে ৩টি বই, বেসরকারিতে ১৩টি!

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

ভাষার মাসে কমবেশি সবার মাঝে মাতৃভাষার প্রীতি, দরদ, ভালোবাসা দেখা যায়। গত বছর শিক্ষা-সংশ্নিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোচনা (পরীক্ষার সংখ্যা কমবে, বইয়ের সংখ্যা কমবে, তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা থাকছে না ইত্যাদি) পত্রপত্রিকায় পড়ে স্বস্তিবোধ করেছিলাম। ভেবেছিলাম, আমাদের দেশের কোমলমতি শিশুদের হাসি ফোটানোর দিন শুরু হতে চলেছে হয়তো। বছরজুড়ে শিক্ষা-সংশ্নিষ্ট আলোচনা ও সিদ্ধান্তের প্রতিফলন দেখতে জানুয়ারি মাসের শুরুতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে বেসরকারি স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের বইয়ের তালিকা দেখে আবার আকাশ থেকে পড়লাম। সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরও জানা যায়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে মোট তিনটি বই বাংলা, ইংরেজি ও অঙ্ক। অন্যদিকে যে শিশুরা বেসরকারি বিভিন্ন স্কুলে ভর্তি হয়েছে, তাদের জন্য সরকার কর্তৃক প্রদত্ত তিনটি বইয়ের পাশাপাশি আরও ১০টি বই যুক্ত করে ১৩টি বইয়ের তালিকা অভিভাবকদের দেওয়া হয়েছে। ঢাকা শহরে অন্তত তিনটি বেসরকারি স্কুলের খোঁজ নিতে গিয়ে এমন চিত্রই পেয়েছি। প্রথম শ্রেণির ১৩টি বইয়ের বিপরীতে কমপক্ষে ৭-৮টি খাতা থাকবে। আরও থাকবে স্কুল কর্তৃক নির্ধারিত মোটা একটি ডায়েরি। প্রথম শ্রেণির শিশুদের জন্য এখানেই শেষ নয়, সঙ্গে খাবার পানি আর নাশতার বাক্স তো থাকছেই। ফলে তাদের বড় একটি ব্যাকপ্যাক বহন করতে হয়। ঢাকা শহরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সবক'টির পরিবেশ, সুনাম এক নয়। যে ক'টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সুনাম রয়েছে, সেখানে ভর্তির সুযোগ পাওয়া রীতিমতো সৌভাগ্যের ব্যাপার। বাকি ছাত্রছাত্রীর অভিভাবকদের নানা বেসরকারি স্কুলের দিকে যেতে হয়। অবাক লাগে, যেখানে সরকারি স্কুলে তিনটি বই, সেখানে বেসরকারি স্কুলগুলোতে কয়েক গুণ হয় কী করে? সরকারি স্কুলের তিনটি বইয়ের মান নিয়ে যদি প্রশ্ন থাকে, আরও তিনটি বাড়িয়ে দিলে এতে হতো ছয়টি বই। ছয়টি বই দিয়েও যদি পছন্দ না হয় আরও তিনটি বাড়িয়ে দিলে, হয় ৯টি বই। ৯টি বই দিয়েও খুশি থাকতে না পারলে আরও তিনটি বই যোগ করলে সংখ্যায় হবে ১২টি। তারপরও স্কুল কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। প্রথম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্য কম হবে মনে করে আরও বাড়িয়ে দেয়।

শহরের ছাত্রছাত্রীরা পড়ার টেবিল, খাওয়া-দাওয়া আর কোচিং সেন্টার চেনে মাত্র। মা-বাবারা ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার সময় নষ্ট না করার নামে খাইয়ে দেন। ফলে শহরের ছাত্রছাত্রীরা শিশুসুলভ শারীরিক গঠন হারিয়ে মোটা, অলস কিংবা দুর্বল শুধু নয়; ঘরে ঘরে চশমা ব্যবহার বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। তার চেয়েও বড় ব্যাপার, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগে অলিগলিতে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষা বিশেষজ্ঞ বনে যাওয়া শুধু ছাত্রছাত্রীরাই নয়, অভিভাবকরাও বাংলায় শিক্ষার মাধ্যমে প্রতিদিন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করেছে। প্রায় সবাই ইংরেজি শিক্ষার দিকে ঝুঁকছে। শহরের অনেক অভিভাবক আছেন, যারা হয় ভর্তির সুযোগ না পেয়ে কিংবা সামর্থ্যের মধ্যে না হওয়াই বাংলা ভাষা শিক্ষা মাধ্যমে পড়াচ্ছেন। এটি আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি বাংলা ভাষার প্রতি বিরাট হুমকি বলে মনে করি। শিশুর শিক্ষা কার্যক্রম হওয়া উচিত সহজ, আনন্দময় ও শিশুবান্ধব। তার পরিবর্তে শিশুকে ১৩টি বই ধরিয়ে দিলে মাতৃভাষা শিক্ষাকে ভীতিগ্রস্ত করে। প্রত্যেক শিশুকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে।

শিশুর জন্য ইংরেজি লেখাপড়া যত না সহজ, বাংলা লেখাপড়া ততটা কঠিন। ইংরেজি লিখতে শিশুরা যতটা মজা পায়, বাংলা লিখতে ততটা কঠিন অনুভব করে। আমাদের বাংলা বর্ণমালায় রয়েছে আকার-ইকার, স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, যুক্তবর্ণ, আরও কত কী! এর মধ্যেও শিশুদের যদি শিক্ষার নামে শুরুতেই ১৩টি বই দিতে থাকি, তারা বাংলা ভাষা শেখার গুরুত্বের চেয়ে ততটা অনাগ্রহী হয়ে পড়বে এবং পড়ছেও। তাই ভাষার মাসে 'সর্বত্র বাংলা ভাষার প্রচলন' একটি ফ্যাশন স্লোগান থেকে বের হয়ে বাংলা ভাষায় শিক্ষার মাধ্যমকে সব ক্ষেত্রে সহজ ও সমান প্রযোজ্য শিক্ষাক্রম হিসেবে বাস্তবায়ন ও কঠোর মনিটরিং এখন সময়ের দাবি। প্রথম শ্রেণিতে ভাষা কাকে বলে, ব্যাকরণ কাকে বলে ইত্যাদি কেন মুখস্থ করে লিখতে হবে? সাধারণ জ্ঞানের নামে কেন কোথায় চা বেশি জন্মে জানতে হবে এবং পরীক্ষার খাতায় লিখে দিয়ে আসতে হবে? এটাও ঠিক, এতে অনেক অভিভাবক খুব খুশি। তারা মনে করেন, ছেলেমেয়েরা দ্রুত সময়ে অনেক কিছু জানছে এবং খাতায় লিখে দিয়ে আসতে পারছে।

বাংলা ভাষায় শিক্ষার সব মাধ্যমকে একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা দরকার। শিক্ষা নিয়ে যেনতেন ব্যবসা বন্ধের উদ্যোগ না নিলে আমরা ভাষা নিয়ে যত গর্ব করি না কেন; আমাদের আগামীর নেতৃত্ব বেড়ে উঠবে বাংলা ভাষার প্রতি এক ধরনের হেয়, বিরক্তিকর মনোভাব নিয়ে। বাংলা ভাষাসহ সব ভাষা বেঁচে থাকবে আজ ও আগামীর শিশুদের মধ্য দিয়ে। তাই শিশুদের শিক্ষা পদ্ধতি হতে হবে আনন্দময়। প্রতি বছর বইমেলা ঘটা করে আয়োজন করা হয়; কিন্তু শিশুরা তাদের পছন্দের দু-একটি বই পড়ার সময় পায় না। তাই বইমেলাতে তরুণদের একটি বড় অংশকে ঘুরে ঘুরে বই দেখার বদলে সেলফি তুলতেই দেখা যায়।

শহরে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেনগুলো বিদ্যালয় নামে বাংলা ভাষার প্রতি শিশুদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে নিরুৎসাহী করছে। এখনই যদি আমাদের সব বেসরকারি স্কুল ও কিন্ডারগার্টেনকে নিয়ে ভাবা না হয়, ভবিষ্যতে বাংলা মিডিয়ামে শুধু নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক শ্রেণিই পড়বে বলে মনে হয়। মাতৃভাষা বাংলাকে বাঁচাতে হলে প্রাথমিক শিক্ষায় কঠোর মনিটরিংয়ের বিকল্প নেই।

 

লেখক: ঞ্যোহদ্মা মং, উন্নয়নকর্মী

স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038299560546875