সরকারিকরণ : মুজিববর্ষের দিকে তাকিয়ে শিক্ষকরা - দৈনিকশিক্ষা

সরকারিকরণ : মুজিববর্ষের দিকে তাকিয়ে শিক্ষকরা

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

বহুল কাঙ্ক্ষিত মুজিববর্ষের যাত্রা শুরু হয়েছে। এটি কেবল কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়। শেখ মুজিবের স্বপ্নের সোনার বাংলায় তাঁর চিন্তা, চেতনা ও আদর্শের কতটুকু প্রতিফলন ঘটেছে- এর একটি বিশ্লেষণাত্মক অধ্যায়। কেবল রং ঢং দিয়ে মঞ্চ সাজিয়ে বড় বড় বুলি আওড়িয়ে মুজিববর্ষ পালন করলে চলবে না। মুজিববর্ষে বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুজিবের চাওয়া পাওয়া আজ কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে-সে যোগ-বিয়োগটি কষতে হবে। কেবল মুখে বঙ্গবন্ধু মুজিবের প্রশংসা নয়, কথায় কাজে এবং হৃদয়-মননে তাঁর নীতি ও আদর্শকে প্রাত্যহিক জীবনে অনুসরণ করার মধ্যে মুজিববর্ষ উদযাপনের সার্থকতা নিহিত।

কেবল মুজিব কোট গায়ে পরে যারা মুজিব সৈনিক সেজেছে, তাদের চিহ্নিত করা দরকার হয়ে উঠেছে। তা না হলে প্রকৃত মুজিব অনুসারীরা পদে পদে কেবল বঞ্চিত নয়, অপমানিতও হবেন। আজ শেখ মুজিবের হাতে গড়া দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বলেই মুজিব কোট পরা লোকের অভাব নেই। কিন্তু, পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশে ক’ জন মুজিব কোট পরা লোক ছিল?  সপরিবারে বঙ্গবন্ধু যেদিন নির্মম ভাবে খুন হয়েছিলেন, সেদিন ক’ জন বুক উঁচু করে প্রতিবাদ করতে পেরেছিল? ‘ইন্নালিল্লাহ’ টুকু পড়ার মতো লোক সেদিন ক’ জন খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল? আজ মুজিববর্ষে সে সব প্রশ্নের উত্তরগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার।

দেশের শিক্ষক সমাজ প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে বরাবর বঙ্গবন্ধু মুজিবের চিন্তা-চেতনায় অনুপ্রাণিত স্বজন। যে দেশপ্রেম নিয়ে তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য জীবন বাজি রেখেছিলেন, সেই দেশপ্রেমটি নাগরিকদের মনে শিক্ষকেরাই জাগিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধুর অন্তরে দেশের জন্য যে ভালোবাসা জন্মেছিল, সেটি নিশ্চয় তাঁর কোনো না কোনো শিক্ষকের অবদান। তাঁর কোনো শিক্ষকের প্রভাবে তিনি একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হতে পেরেছিলেন। শিক্ষকের মূল দায়িত্ব এই যে, তিনি তার ছাত্রের মধ্যে দেশপ্রম ও মানবপ্রেম জাগ্রত করে দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের শিক্ষকেরা সেটি করে দিতে পেরেছিলেন বলে আমরা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি মুজিবের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। সে কারণে শেখ মুজিব শিক্ষক সমাজের আত্মজ মানুষ। শিক্ষকেরাও তাঁর আত্মার পরমাত্মীয়। উভয়ের মাঝে এক অসাধারণ ও অদৃশ্য প্রীতির বন্ধন।

শেখ মুজিবের বাগ্মিতা ছিল অসাধারণ। তিনি সেটিও তাঁর কোনো না কোনো শিক্ষকের কাছ থকে অর্জন করেছিলেন। কিংবা হতে পারে তাঁর কোনো শিক্ষকের ভাষণ বা বক্তৃতা অনুসরণ করে করে তিনি যাদুকরি এক ভাষণের অধিকারী হতে পেরেছিলেন। তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটি কোনো শিক্ষকের চিন্তা চেতনার বহিঃপ্রকাশ হতে পারে। একজন শেখ মুজিবের মনে বিপ্লবী চেতনার বীজটি হয়তো বা তাঁর কোনো শিক্ষক রোপন করে দিয়েছিলেন। শেখ মুজিব আজ পর্যন্ত বেঁচে থাকলে পদে পদে এর প্রমাণ পাওয়া যেত। আজ তিনি জীবিত নেই বলে শিক্ষক সমাজ নানাভাবে অবহেলিত ও বঞ্চনার শিকার। বিশেষ করে দেশের বেসরকারি বলে কথিত যে শিক্ষক সম্প্রদায়, তাদের কষ্টের কথা লিখে শেষ করবার মতো নয়। একটি জাতির দীনতা তখনই ফুটে ওঠে, যখন সে জাতির শিক্ষক সমাজ নানারূপ বঞ্চনা ও অবহেলার মধ্যে দিনাতিপাত করে থাকেন।

আজ যখন মুজিববর্ষ উদযাপিত হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মদিনের ঐতিহাসিক ক্ষণ গণনা শুরু হয়েছে। ঠিক তখন দেশের শিক্ষক সমাজ বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকরা যে কত কষ্ট ও অবহেলার জীবন অতিক্রম করছেন, তা মুজিববর্ষ উদযাপনের সকল আয়োজনকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। মুজিববর্ষের পর আমরা যখন স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উদযাপন করার প্রস্তুতি নিচ্ছি, ঠিক সে সময় কোনো শিক্ষকের বাড়ি ভাড়া মাত্র ১০০০ টাকা আর চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা সত্যি বেমানান। উৎসব ভাতা মাত্র ২৫ শতাংশ। কোনো রকমের বদলি ও পদোন্নতি নেই। এসব বিষয় যদি মুজিববর্ষের ঐতিহাসিক ক্ষণটির আগে পর্যন্ত সমাধা করা না হয়, তবে তা

মুজিববর্ষের গায়ে কলঙ্ক তিলকের ন্যায় চিরদিন লেগে থাকবে। লজ্জা হবে গোটা দেশ ও জাতির। শেখ মুজিবের আত্মার প্রতি অশ্রদ্ধাই দেখানো হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যদি আরও দশটি বছর মাত্র ক্ষমতায় থাকতে পারতেন, তবে আজ বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। অন্য এক উচ্চতা ও মর্যাদায় পৌঁছে যেত বাংলাদেশ। সে সুখ আমাদের কপালে সয়নি। অন্তত শিক্ষা ও শিক্ষকের জন্য আর কোনো দুর্দশা বাকি রইতো না-সে কথাটি জোর গলায় বলা যায়। আমাদের শিক্ষায় আজ কত বিশৃংখল অবস্থা। নানা দুর্নীতি ও অনিয়মে ভরে আছে শিক্ষার পবিত্র অঙ্গন। নোট, গাইড ও কোচিং বাণিজ্যের বদনাম আজ আমাদের সারা গায়ে। কোনো কোনো শিক্ষকের নৈতিক স্খলনের কারণে পুরো শিক্ষক সমাজ বিতর্কের বেড়াজালে আবদ্ধ। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় শিক্ষার যে অংশ, তাতে বেশিরভাগ জায়গায় কমিটির দৌরাত্ম্য ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে শিক্ষার বারোটা বেজে যাচ্ছে। নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও জবাবদিহিতার অভাবে শিক্ষা শিঁকেয় উঠে যেতে বসেছে। যে যার মতো করে শিক্ষায় দোকান খুলে বসে আছে।

শেখ মুজিব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, শিক্ষায় অরাজকতা ও ব্যবসা বন্ধের একমাত্র পথ সরকারিকরণ। তাই, তিনি বিধ্বস্ত অর্থনীতির উপর দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র ৩ বছরের মাথায় কাউকে কিছু না বলেই প্রাথমিক শিক্ষাস্তরটি সরকারিকরণ করেছিলেন। তিনি বেঁচে থাকলে ১০ বছরের মাথায় মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর এবং কুড়ি বছরের মাথায় পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই সরকারিকরণ করে দিয়ে যেতেন। সে সুখটিও আমাদের কপালে সয়নি। আমরা সত্যি দুর্ভাগা এ কারণে যে, একজন মুজিব বেঁচে না থাকার কারণে প্রায় পঞ্চাশ বছরের মাথায় এসেও আমরা কেবল মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরটি পর্যন্ত সরকারিকরণ করতে পারি নাই। এ লজ্জা আমাদের সবার। এ কষ্ট আমাদের সকলের।

অন্তত মুজিববর্ষে সে কষ্ট ও লজ্জা থেকে পরিত্রাণ দেবার জন্য মুজিবকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি একটু এগিয়ে আসবেন? একমাত্র চাইলে তিনিই পারেন। এখানে বঙ্গবন্ধু মুজিবের মতো সাহস কেবল একজনের আছে। তিনি ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ জননেত্রী শেখ হাসিনা।

লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।

পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন কলেজ পরিচালনা পর্ষদ থেকে ঘুষে অভিযুক্ত সাংবাদিককে বাদ দেওয়ার দাবি - dainik shiksha কলেজ পরিচালনা পর্ষদ থেকে ঘুষে অভিযুক্ত সাংবাদিককে বাদ দেওয়ার দাবি পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0042071342468262