সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই ইংলিশ মিডিয়ামে - দৈনিকশিক্ষা

সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই ইংলিশ মিডিয়ামে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

ইংলিশ মিডিয়াম ও ইন্টারন্যাশনাল স্কুল দেশের শিক্ষা খাতের বড় একটি অংশ হলেও এর নিয়ন্ত্রণ নেই সরকারের হাতে। নেই কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা ও তদারকি প্রতিষ্ঠান। স্কুলগুলোতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর ৯৯ ভাগ বাংলাদেশি হলেও সেখানে কী পড়ানো হচ্ছে, কারা শিক্ষক, টিউশন ফি ও ভর্তি ফি কত তার পূর্ণাঙ্গ তথ্য নেই মন্ত্রণালয় বা সরকারের কোনো সংস্থার কাছে। আর এই সুযোগে পাঠ্যসূচি, ভর্তি ফি, সেশন চার্জ, শিক্ষক নিয়োগসহ যাবতীয় কার্যক্রম চলছে লাগামহীনভাবে। নানা অজুহাতে অভিভাবকদের কাছ থেকে বছরে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। নিবন্ধন ছাড়াই অলিতে-গলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে মানহীন স্কুল। রোববার (১০ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে  এসব তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেনশামীম আহমেদ। 

বিগত দিনে কয়েকটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ওঠে। আবার কিছু প্রতিবেদনে ওঠে আসে অনেক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের নাম জানলেও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নাম জানে না। তারা জানে না বঙ্গবন্ধু কে, স্বাধীনতা বা বিজয় দিবস কী অথবা জাতীয় সংগীতের কত চরণ গাওয়া হয়। এছাড়া বছর বছর বেতন বৃদ্ধি ও বিভিন্ন ফি’র নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় অনেকবার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছেন অভিভাবকরা। এসব নিয়ে সমালোচনার মুখে কয়েকবার ইংলিশ মিডিয়াম নিয়ে নীতিমালা তৈরি ও তদারকির উদ্যোগ নেওয়া হয়। দফায় দফায় সরকারের উচ্চপর্যায়ে বৈঠক হয়। গঠন করা হয় টাস্কফোর্স। তবে, অজ্ঞাত কারণে কোনোভাবেই ইংলিশ মিডিয়ামের লাগাম টানা যায়নি।

এ ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বিদেশি কারিকুলামে পড়ানো ইংলিশ মিডিয়ামগুলোকে হয়তো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, তবে একটা কাঠামোর মধ্যে আনা জরুরি। কারণ এটা শিক্ষা খাতের একটা বড় অংশ। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে আমাদের একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। আমরা সুপারিশমালা দিয়েছি। বাকি কাজ সরকারের।
নিবন্ধন নেই ৬০ ভাগ প্রতিষ্ঠানের : সারা দেশের অলিতে-গলিতে গড়ে উঠেছে ইংলিশ মিডিয়াম বা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল নামধারী হাজারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নিবন্ধন বাধ্যতামূলক হলেও শতকরা ৬০ ভাগের বেশি প্রতিষ্ঠানেরই তা নেই। ‘রেজিস্ট্রেশন অব প্রাইভেট স্কুলস অর্ডিন্যান্স-১৯৬২’র অধীনে ২০০৭ সাল থেকে একটি নীতিমালায় বেসরকারি (ইংরেজি মাধ্যম) বিদ্যালয়ের সাময়িক নিবন্ধন প্রদান শুরু হয়। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাবের খাতায় দেশে এখন পর্যন্ত ১৫৯টি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের নিবন্ধন রয়েছে এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬৪ হাজার ৫০৭ জন। অন্যদিকে বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে সারা দেশে এ ধরনের স্কুলের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩শ। শিক্ষার্থী প্রায় তিন লাখ। আবার বেসরকারি নানা সূত্রের হিসাবে সারা দেশে এমন স্কুলের সংখ্যা সাড়ে ৪ হাজারের উপরে।

লাগামহীন ফি’তে দিশাহারা অভিভাবক : নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ভর্তি ফি, টিউশন ফি ও নানা অজুহাতে অভিভাবকদের থেকে লাগামহীনভাবে অর্থ আদায় করছে ইংলিশ মিডিয়ামগুলো। ধরন ভেদে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি ফি ৫০ হাজার থেকে সাড়ে ছয় লাখ টাকা। টিউশন ফি বার্ষিক ৩০ হাজার থেকে ২৬ লাখ টাকা পর্যন্ত। এছাড়া রয়েছে ভর্তি ফরম, ইন্টারনেট চার্জ, উন্নয়ন ফি, কম্পিউটার ল্যাব চার্জ, ডাইরি, আইডি কার্ড, বই, এক্সারসাইজ বুক, স্টেশনারি ফিসহ হরেক খাত। প্রতি বছরই এ খাতগুলোয় টাকার অঙ্ক লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। এ নিয়ে অভিভাবকদের হাজারও অভিযোগ থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অবশেষে আদালত পর্যন্ত গড়ায় বিষয়টি। ২০১৭ সালের মে মাসে আদালত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পুনঃভর্তি ফি না নেওয়ার নির্দেশ দিলে স্কুলগুলো চতুরতার সঙ্গে সেশন ফি বাদ দিয়ে টিউশন ফি ও অন্যান্য নানা ফি বাড়িয়ে দেয়। ফলে আদালতের নির্দেশ থাকলেও শিক্ষার খরচ কমেনি এতটুকুও। এখনো এ নিয়ে আদালতে একাধিক মামলা চলছে বলে জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর ডিপিএস এসটিএস স্কুলে ২০১৯-২০ সেশনে প্রি কেজি শ্রেণিতে ভর্তি হতে একজন শিক্ষার্থীকে শুরুতে দুই হাজার টাকার ফরম কিনতে হবে। ভর্তি পরীক্ষায় টিকে গেলে এককালীন ভর্তি ফি ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা, বই ও পোশাক বাবদ ১৫-১৬ হাজার টাকা ও টিউশন ফি বাবদ প্রতি তিন মাসে দিতে হবে ৪১ হাজার ২০৫ টাকা। টাকার এই অঙ্ক জুলাই মাসের আগে বাড়তে পারে বলেও স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে। আবার এ স্কুলে গ্রেড ১২ শ্রেণিতে টিউশন ফি প্রতি চার মাসে ৮৯ হাজার টাকা। ইয়েল ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ২০১৮-১৯ সেশনে প্লে গ্রুপে ভর্তি ফি নেওয়া হয়েছে ৪৮ হাজার টাকা। আগে পুনঃভর্তি চালু থাকায় প্লে গ্রুপে বেতন ছিল ৫ হাজার টাকার মতো। আদালতের আদেশে পুনঃভর্তি তুলে দিয়ে প্লে শ্রেণিতেই বেতন বাড়ানো হয় ১ হাজার ৮০০ টাকা। হার্ডকো ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ২০১৭-১৮ সেশনে গ্রেড-৫ এর একজন শিক্ষার্থীর টিউশন ফি ছিল ৯ হাজার ৯১৮ টাকা, চলতি সেশনে হয়েছে ১০ হাজার ৯০০ টাকা। এ ছাড়া আরও চার-পাঁচটি খাতে ফি ৭-১০ শতাংশ বেড়েছে। ওয়ারীর ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড স্কুলে প্লে শ্রেণিতে ২০১০-১১ সেশনে টিউশন ফি ছিল ১ হাজার ৬০০ টাকা, ২০১৮-১৯ সেশনে রাখা হচ্ছে ৭ হাজার ২৬০ টাকা।

মান নিয়ে প্রশ্ন : দেশের শীর্ষ সারির অধিকাংশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ব্রিটিশ, ক্যামব্রিজ কিংবা এডেক্সেলের সিলেবাস অনুসরণ করে পড়ানো হয়। তবে ক্যামব্রিজ ও এডেক্সেলের প্লে শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো পাঠ্যসূচি না থাকায় স্কুলগুলো নিজেদের পছন্দের বইয়ে প্রাধান্য দেয়। তবে আন্তর্জাতিক এসব কারিকুলামে প্লে গ্রুপ থেকে একজন শিক্ষার্থীকে কীভাবে গড়ে তোলা হবে সে ব্যাপারে দিকনির্দেশনা থাকে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, হাতেগোনা কিছু স্কুল সেই নির্দেশনা মানলেও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই মানে না। বড় কয়েকটি স্কুল ছাড়া বেশিরভাগেরই নেই নিজস্ব ক্যাম্পাস। নেই খেলার মাঠ, ল্যাব বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। কোনো একটি ভবনের এক বা একাধিক ফ্লোর ভাড়া নিয়েই চলছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। আবার অনেক স্কুলের পড়ানোর সীমা চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। সেখানে নির্ধারিত কোনো পাঠ্যক্রমই অনুসরণ করা হচ্ছে না। এসব স্কুল থেকে পড়ে অন্য স্কুলে ভর্তি হতেও জটিলতায় পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।

৭ বছরেও হয়নি নীতিমালা : ২০১২ সালে ইংলিশ মিডিয়ামের নীতিমালা তৈরিতে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের নেতৃত্বে কয়েকটি সভা হয়। সভাগুলোতে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, রাশেদা কে চৌধুরী, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ অন্যরা অংশ নেন। ছিলেন বিভিন্ন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের স্বত্বাধিকারীরাও। তবে অদৃশ্য শক্তির হস্তক্ষেপে নীতিমালা আর আলোর মুখ দেখেনি।

মানছে না হাইকোর্টের নির্দেশনা : ২০১৭ সালের মে মাসে আদালত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল নিয়ে কিছু নির্দেশনা দেয়। এতে বলা হয়, অভিভাবকদের সব পক্ষের অংশগ্রহণে গণতান্ত্রিকভাবে ম্যানেজিং কমিটি গঠন, বিভিন্ন ফি ও স্কুলের যাবতীয় খরচ নির্ধারণ করবে ম্যানেজিং কমিটি। পরবর্তী ক্লাসে ওঠার সময় সেশন ফি বা অন্য যে কোনো ফি নেওয়া যাবে না। শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। পাঠ্য বইয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় সম্পর্কে অভিভাবকদের অডিট রিপোর্ট প্রদান করতে হবে। রাজধানীর অধিকাংশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে এ নির্দেশনা মানা হচ্ছে না বলে অভিভাবকদের অভিযোগ।

 

সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0070829391479492