রহস্যময় সংখ্যা পাই (শ্চ)-এর ইতিহাস সুপ্রাচীন, এই সংখ্যার উদ্ভব ঘটে প্রায় চার হাজার বছর আগে। ১৭০৬ সালে ওয়েলেশ গণিতবিদ উইলিয়াম জোনস সর্বপ্রথম গ্রিক অক্ষর পাই ব্যবহার করেন। এরপর ১৭৩৭ সালে সুইস গণিতবিদ এবং পদার্থবিজ্ঞানী লিওনহার্ড অয়লার এই সংখ্যাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। তখন থেকে প্রকৌশলী, পদার্থবিদ, স্থপতি, ডিজাইনার থেকে শুরু করে অনেকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাই ব্যবহার করে আসছেন। শনিবার (১৪ মার্চ) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, পদার্থবিদ ল্যারি শ ১৯৮৮ সালের ১৪ মার্চকে পাই দিবস হিসেবে মনোনীত করেন। কারণ, ৩.১৪ সংখ্যাটি পাই-এর প্রথম তিনটি অঙ্কের সমান। বিশেষ এই দিনটি আবার আলবার্ট আইনস্টাইনেরও জন্মদিন। ২০০৯ সালে শ-এর কর্মস্থল সান ফ্রান্সিসকোভিত্তিক বিজ্ঞান জাদুঘরে সর্বপ্রথম পাই দিবস উদযাপিত হয়। মার্কিন জাতীয় প্রতিনিধি পরিষদে আইন পাস করার পরিপ্রেক্ষিতে এই দিনটি সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। ২৬ নভেম্বর ২০১৯ সালে ইউনেস্কোর ৪০তম সাধারণ অধিবেশনে ১৪ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণিত দিবস (আইডিএম) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ১৩ মার্চ দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রথমবারের মতো ইউনেস্কোর সদর দপ্তর প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম আইডিএম ২০২০-এর প্রতিপাদ্য হলো :গণিত সর্বত্রই রয়েছে।
গণিত দিবসের প্রধান লক্ষ্য হলো- সর্বস্তরে গণিতের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলা (এসডিজি-৯); উন্নয়নশীল দেশের নারী ও শিশুদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রেখে গাণিতিক ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষায় সক্ষমতা বৃদ্ধি করা (এসডিজি-৪); জেন্ডারভিত্তিক সমতা অর্জন এবং গণিতে নারীদের ক্ষমতায়ন (এসডিজি-৫); প্রযুক্তি ও সমাজ পরিচালনার বীজ হিসেবে মৌলিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার ওপর গুরুত্ব প্রদান (এসডিজি-৮); অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, গণপরিবহন, টেলিযোগাযোগের মতো ক্ষেত্রে গণিতের ভূমিকা সম্পর্কে ধারণা প্রদান করা (এসডিজি-৩); প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি এবং উদীয়মান রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে গণিতের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি (এসডিজি-১১); জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং অর্থনীতি গতিশীল করতে গণিতের ভূমিকা অপরিহার্য (এসডিজি-১৪-১৫); বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, জীবনের মানোন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে গণিত ও গণিত শিক্ষার অবদান অনস্বীকার্য (এসডিজি-১৭)।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে গণিতের প্রায়োগিক ব্যবহার হচ্ছে। যেমন- সার্চ ইঞ্জিনগুলো জটিল গাণিতিক মডেলের মাধ্যমেই ইন্টারনেটকে পরিচালনা করে। সিটি স্ক্যান, এমআরআইর মতো মেডিকেল ইমেজিং ডিভাইস গাণিতিক অ্যালগরিদমের মাধ্যমে সংখ্যাসূচক তথ্য থেকে ইমেজ তৈরি করে। মানবদেহের জিনোমের ডিকোডিং হলো গণিত, পরিসংখ্যান ও কম্পিউটার বিজ্ঞানের একটি অন্যতম বিজয়। গণিতের মাধ্যমে আমরা কৃষ্ণগহ্বর ও সৌরজগতের প্রথম ছবি পেতে সমর্থ হই। সুরক্ষিত যোগাযোগের জন্য ক্রিপ্টোগ্রাফি সংখ্যাতত্ত্বের ওপর নির্ভরশীল। গণিতশাস্ত্র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে বিশ্বকে পরিবর্তন করে দিচ্ছে। পরিবহন ও যোগাযোগ নেটওয়ার্ককে অপটিমাইজ করতে গণিতশাস্ত্র ব্যবহূত হয়। মহামারির বিস্তার এবং নিয়ন্ত্রণ করতে গণিতের সাহায্য নেওয়া হয়। স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থার কার্যকরী পরিকল্পনা এবং পরিচালনায় গণিতের মডেল কাজে লাগে। জনগণের ইচ্ছাকে আরও ভালোভাবে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে গণিত সাহায্য করে। গণিতশাস্ত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগ (যেমন : বন্যা, ভূমিকম্প, হারিকেন প্রভৃতি) ঝুঁকি অনুধাবন এবং আগাম প্রস্তুতিতে সহায়তা করে।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে গণিত অপরিহার্য। যেমন- বৈশ্বিক পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র্যে তার প্রভাব মডেলিংয়ের জন্য গণিত ব্যবহূত হয়। গণিত শিক্ষা নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নত ভবিষ্যৎ অর্জনে সহযোগী ভূমিকা রাখে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে স্যাটেলাইট চিত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ ও মানচিত্র অঙ্কন করা যায়। গাণিতিক ও বৈজ্ঞানিক সাক্ষরতা প্রতিটি নাগরিককে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলো আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করে। বৈশ্বিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করতে গণিত অপরিহার্য।
গণিত যাপিতজীবনে অবদান রাখছে। বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে গণিতের অবদান লক্ষণীয়। নির্মাতা, কৃষক, শ্রমিক, বিপণিবিতান, ক্রীড়াবিদ প্রতিদিনই কিছু না কিছু গাণিতিক ধারণা ব্যবহার করে থাকেন। গণিত নক্ষত্র, সূর্য ও জিপিএস স্যাটেলাইটভিত্তিক নেভিগেশনের মাধ্যমে আমাদের পথ খুঁজে পেতেও সহায়তা করে। আবহাওয়ার সঠিক পূর্বাভাস পেতে উন্নত বায়ুমণ্ডলীয় মডেল ব্যবহার করা হয়। মহাকাশ গবেষণা ক্ষেত্রেও রয়েছে গণিতের উল্লেখযোগ্য ব্যবহার।
লেখক: ড. মো. শহীদুল ইসলাম, আহ্বায়ক, আন্তর্জাতিক গণিত দিবস উদযাপন কমিটি ও অধ্যাপক; গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়