সহজলভ্য ও সর্বজনীন শিক্ষা-সংগ্রামের শুরু - Dainikshiksha

সহজলভ্য ও সর্বজনীন শিক্ষা-সংগ্রামের শুরু

অধ্যাপক ড. এম এ মাননান |

স্বাধীন দেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার শিক্ষাকে সহজলভ্য ও সর্বজনীন করার জন্য গণমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। ড. কুদরত-এ-খুদার শিক্ষানীতি নামে তা ব্যাপক গণসমর্থন লাভ করে। কিন্তু এর পেছনের ইতিহাসটা বিভীষিকাময়, নানা চড়াই-উতরাই আর কণ্টকময়।

১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। এ দিনটিতেই বাংলার দামাল তারুণ্য রুখে দাঁড়িয়েছিল পাকিস্তানি শাসকদের শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ আর শিক্ষাক্ষেত্রে সৃষ্ট বৈষম্যের বিরুদ্ধে। ১৯৬২ সালে তত্কালীন সরকারের আমলের প্রথম শিক্ষা কমিশন—শরীফ শিক্ষা কমিশন-এর রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরপরই ফুঁসে ওঠে ছাত্রছাত্রীরা। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় শিক্ষাবিদসহ সংস্কৃতিসেবীরা। সেকালের বিখ্যাত ঢাকা কলেজ থেকে শুরু হয় আন্দোলন। পরবর্তীকালে যুক্ত হয় জগন্নাথ কলেজ, ইডেন কলেজ, কায়েদে আজম কলেজ, তোলারাম কলেজসহ অন্যান্য কলেজের শিক্ষার্থী। নেতৃত্বে ছিলেন ইডেন কলেজের ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি মতিয়া চৌধুরী, ঢাকা কলেজের ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক কাজী ফারুক আহমেদসহ অনেক ছাত্রনেতা যারা পরবর্তীকালেও শিক্ষাবিষয়ক আন্দোলনে অনেক অবদান রেখেছেন। পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরাচার আইয়ুব খান ওই আন্দোলনকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে স্তব্ধ করতে উদ্যত হয়। চলে পুলিশের গুলি-টিয়ারগ্যাস ও লাঠিচার্জ। রঞ্জিত হয় ঢাকার রাজপথ। শহীদ হন বাবুল, গোলাম মোস্তফা ও ওয়াজিউল্লাহ। ছাত্রসমাজ ১৭ সেপ্টেম্বর তারিখটিকে ‘শিক্ষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। আন্দোলনের মুখে শরীফ কমিশন রিপোর্ট আর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

কুখ্যাত স্বৈরশাসক আইয়ুব খান, ক্ষমতা দখলের মাত্র ২ মাস পর ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। এই কমিশন ১৯৫৯ সালে আগস্ট মাসের মধ্যে একটি শিক্ষা রিপোর্ট প্রণয়ন করে। ২৭ অধ্যায়ে বিভক্ত এই রিপোর্টে প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চতর স্তর পর্যন্ত সাধারণ, পেশামূলক শিক্ষা, শিক্ষক প্রসঙ্গ, শিক্ষার মাধ্যম, পাঠ্যপুস্তক, হরফ সমস্যা, প্রশাসন, অর্থ বরাদ্দ, শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিষয়ক বিস্তারিত সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়। এতে আইয়ুব শাহীর ধর্মান্ধ, পুঁজিবাদী, রক্ষণশীল, সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষাসংকোচন নীতির পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছিল। আইয়ুব সরকার এই রিপোর্টের সুপারিশ গ্রহণ করে তা ১৯৬২ সাল থেকে বাস্তবায়ন করতে শুরু করে।

শরীফ কমিশনের শিক্ষা সংকোচন নীতি কাঠামোতে শিক্ষাকে তিন স্তরে ভাগ করা হয়—প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চতর। ৫ বছরের প্রাথমিক ও ৩ বছরের উচ্চতর ডিগ্রি কোর্স এবং ২ বছরের স্নাতকোত্তর কোর্সের ব্যবস্থা থাকবে বলে প্রস্তাব করা হয়। উচ্চশিক্ষা ধনিকশ্রেণির জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এজন্য পাস নম্বর ধরা হয় শতকরা ৫০, দ্বিতীয় বিভাগ শতকরা ৬০ এবং প্রথম বিভাগ শতকরা ৭০ নম্বর।

এই কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, ছাত্র-শিক্ষকদের কার্যকলাপের ওপর তীক্ষ নজর রাখার প্রস্তাব করে। শিক্ষকদের কঠোর পরিশ্রম করানোর জন্য ১৫ ঘণ্টা কাজের বিধান রাখা হয়েছিল। শিক্ষকরা যাতে ছাত্রদের সঙ্গে স্বদেশ, স্বজাতি নিয়ে আলোচনা ও তর্কের সুযোগ না পায় সে অপচেষ্টা করা হয়েছিল। শুধু ক্লাসের মাঝে এক ধ্যানে মনোনিবিষ্ট রেখে তারা রোবোটিক শিক্ষক-ছাত্র তৈরির চক্রান্ত করেছিল। রিপোর্টের শেষাংশে বর্ণমালা সংস্কার করা এবং বাংলা ও উর্দুর স্থলে রোমান বর্ণমালা প্রয়োগ এবং প্রতিষ্ঠার জন্য কমিটি গঠনের প্রস্তাব করে এই কমিশন।

ছাত্র ইউনিয়ন আইয়ুবের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৫৯ সালে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনকে নিয়ে একুশ উদযাপনের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ১৯৬০ ও ১৯৬১ সালে এ ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত থাকে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী পালন করার মাধ্যমে ছাত্রসমাজ সরকারের সাম্প্রদায়িক ও বাঙালিবিরোধী মনোভাবকে অগ্রাহ্য করে।

১৯৬১ সালে আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টির বৈঠকের পর আন্দোলন বিষয়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ৩০ ডিসেম্বর এই বৈঠকে সামরিক শাসনের পরিবর্তে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠা, ‘আইয়ুব শিক্ষানীতি’ বাতিল চায় তারা। রাজবন্দীদের মুক্তি প্রভৃতি বিষয়ে আন্দোলন শুরু করার প্রস্তাব করে যা ওই মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত আকারে গৃহীত হয়। আরও সিদ্ধান্ত হয় যে, ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হবে স্বৈরতন্ত্র বিরোধী জঙ্গি আন্দোলন।

১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি প্রবীণ নেতারা অন্যায়ভাবে হেনস্তা ও গ্রেফতার হলে ৩১ জানুয়ারি ৪টি ছাত্র সংগঠন মধুর ক্যান্টিনে যৌথভাবে বসে। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন ছাড়া বাকি দুটি সংগঠন (ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন ও ছাত্রশক্তি) ছিল সরকারের সমর্থক। এদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সরকারবিরোধী আন্দোলনকে ভুল পথে পরিচালিত করা।

১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ২ ফেব্রুয়ারি রাজপথে জঙ্গি মিছিল সামরিক আইন ভঙ্গ করে। ৪-৫ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে। ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার ছাত্র প্রতিবাদ সমাবেশে উপস্থিত হয়।

৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার পর ছাত্ররা হল ত্যাগ করছেন না দেখে পুলিশ ও সেনাবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় ঘেরাও করে ছাত্রদের জোর করে বের করে দেয়। সারা দেশে আইয়ুব বিরোধী, শিক্ষানীতি বিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। মার্চে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর কেন্দ্রীয়ভাবে আন্দোলন চাঙ্গা হতে থাকে।

অবশেষে ১৯৬২ সালের ২৫ জুন দেশের ৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক এক বিবৃতিতে আইয়ুব ঘোষিত শাসনব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করে নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দাবি জানান। প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল স্কুল, ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইনস্টিটিউটসহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্ব-স্ব দাবির  ভিত্তিতে জুলাই-আগস্ট মাস জুড়ে আন্দোলন চলতে থাকে।

১৭ সেপ্টেম্বর সারা দেশব্যাপী হরতাল পালিত হয়। সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ-মিছিল হয়। জগন্নাথ কলেজে গুলি হয়েছে এ গুজব শুনে মিছিল দ্রুত নবাবপুরের দিকে ধাবিত হয়। হাইকোর্টে পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে না গিয়ে মিছিল আব্দুল গনি রোড ধরে যেতে থাকে। পুলিশ তখন পিছন থেকে মিছিলে হামলা চালায়। লাঠি চার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও গুলি চালায়। পুলিশের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংঘর্ষ বাধে ঢাকা কোর্টের সামনে। এখানেও পুলিশ ও ইপিআর গুলি চালায়। এতে প্রচুর আহত হয়, ৩ জন শহীদ হয় এবং শত শত ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। বাবুল, গোলাম মোস্তফা ও ওয়াজিউল্লাহ শহীদ হন। ওই দিন শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশে মিছিলের ওপর পুলিশ হামলা চালায়। টঙ্গীতে ছাত্র-শ্রমিক মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়ে হত্যা করে সুন্দর আলী নামের এক শ্রমিককে। শেষ পর্যন্ত বুলেট, বেয়নেট আর রক্তচক্ষু কিছুই স্তব্ধ করতে পারেনি দামাল সন্তানদের দাবিকে।

১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক গঠিত এবং ড. কুদরত-এ-খুদার সভাপতিত্বে জাতীয় শিক্ষা কমিশন-এর রিপোর্টের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুকন্যার নির্দেশনায় ২০১০ সালে প্রণীত হয় গণমুখী শিক্ষানীতি এবং সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় এই নীতি বাস্তবায়নের কাজ। প্রথমবারের মতো শিক্ষা আইনও আলোর মুখ দেখার পথে।

লেখক: উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

 

সৌজন্যে: ইত্তেফাক

এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0080409049987793