বায়ুদূষণের কারণে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত শহরের সব স্কুল বন্ধ ঘোষণা করেছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ওই শহরেরই অরুণ জেটলি আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে আজ সন্ধ্যায় আরও খাটুনির ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে নামছে দুই দল—ভারত ও বাংলাদেশ। গত দুই দিন তাই অনুশীলনের সময় মুখোশ ব্যবহার করতে দেখা গেছে বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের।
অবশ্য গোলার্ধের এ প্রান্তে বায়ুদূষণ অস্বাভাবিক কোনো পরিস্থিতি নয়, ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়েও তো কম চর্চা হয় না। তবে দিল্লিতে বুক ভরে শ্বাস নেয়ার অস্বস্তি জানান দেয় প্রতিবার। দুই বছর আগে এ শহরেই টেস্টে বোলিংয়ের সময় বমি পর্যন্ত করেছিলেন শ্রীলঙ্কার পেসার গামাগে। এরপর লঙ্কানদের মুখোশ পরে ফিল্ডিং করা নিয়ে সরব হয়েছিল ভারতের সোশ্যাল মিডিয়া। কিন্তু এবার উল্টো সমবেদনাই পাচ্ছেন সফরকারী ক্রিকেটাররা। এমনিতেই ভারী বাতাসের দিল্লিকে ‘বিপজ্জনক’ করে দিয়ে গেছে কদিন আগের দিওয়ালি, বিস্তর পটকা ফোটানো হয়েছে যে।
তাই ভরদুপুরেও দিল্লির চারপাশ দেখতে হয় ঘোলা দৃষ্টিতে।
মাঝেমধ্যে দূষণের ভারী পর্দা সরিয়ে দৃষ্টিসীমার মধ্যে থাকা দূরের দৃশ্যও আবছায়ার মতো দেখায়।
কিন্তু ক্রিকেট মাঠে গড়ানোর পর তো আর প্রকৃতির চর্চায় ব্যস্ত থেকে লাভ নেই। বাংলাদেশ কোচ রাসেল ডমিঙ্গো আগের দিনই বলে দিয়েছেন, ‘একই পরিবেশে দুই দলই খেলবে।’ তার মানে ওসব নিয়ে অনুযোগ করা অকারণ। নভেম্বরের শুরুতে দিল্লিতে সন্ধ্যার কুয়াশা নিয়েও আশঙ্কা আছে। ওটাও নিয়ন্ত্রণের বাইরে, টস জিতলে তবু সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে—সেটাও ভাগ্যের ব্যাপার।
ভারতে আনুষ্ঠানিকভাবে আজ প্রথম পূর্ণাঙ্গ সফর শুরুর আগে বাংলাদেশ দলের সামনে আরও কিছু বিপত্তি আছে। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ ১০ নম্বরে। আর ভারত? আশার কথা যে এই ফরম্যাটের সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের র্যাংকিংও খুব ভালো নয়—অতি সম্প্রতি নেমে এসেছে ৫-এ। তবু কে না জানে, র্যাংকিংয়ের অবস্থান থেকেও দুই দলের সামর্থের ব্যবধান বেশি বই কম নয়। এমনি এমনি তো আর টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের সঙ্গে ৮-০ ব্যবধানে এগিয়ে নেই ভারত!
তবে সব কিছু ছাপিয়ে বল মাঠে গড়ানোর আগে বাংলাদেশ ক্রিকেটকেন্দ্রিক আলোচনার শীর্ষে সাকিব আল হাসান। এটা তো অনস্বীকার্য যে টি-টোয়েন্টিতে তিনি বাংলাদেশের একমাত্র ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। আইপিএল থেকে শুরু করে বিগ ব্যাশ—বৈশ্বিক ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচেয়ে আকর্ষক চরিত্র তিনি। কিন্তু ভারতীয় এক জুয়াড়ির সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি ‘রিপোর্ট’ না করার দায়ে ২৯ অক্টোবর থেকে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ তিনি।
চোট কিংবা নিষেধাজ্ঞার কারণে আগেও সাকিবহীন ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে বাংলাদেশের। অনেক ম্যাচ জিতেছেও। কিন্তু সাকিবের এবারের নিষেধাজ্ঞার প্রকৃতি ভিন্ন। ভিন্ন বলেই তাঁর অলরাউন্ড নৈপুণ্যের শূন্যতা ভরাট করার চিন্তার পাশাপাশি ড্রেসিংরুম থেকেও সাকিবের ছবিটা একপাশে সরিয়ে রাখার গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে অধিনায়ক মাহমুদ উল্লাহ এবং কোচকে।
অবশ্য পেশাদারের রুটিন ওয়ার্ক শুরু হয়ে গেলে এ জাতীয় আবেগে ভেসে যাওয়ার রেকর্ড নেই, বাংলাদেশ দলে তো বটেই! কিন্তু তিন নম্বরে সাকিবের ব্যাটিং আর নতুন বলে কিংবা প্রথম পরিবর্তন হিসেবে তাঁর বাঁহাতি স্পিনের বিকল্প তো আর একজনের মাঝেই খুঁজে পাচ্ছে না বাংলাদেশ। তিনে বাঁহাতি কম্বিনেশন খুঁজতে গেলে একমাত্র বিকল্প নবাগত মোহাম্মদ নাইম। সাকিবের বাঁহাতি স্পিনের বিকল্প হতে পারেন আরাফাত সানি কিংবা তাইজুল ইসলাম। আর সেটা করতে গিয়ে ব্যাটিং-বোলিংয়ের সঙ্গে সামান্য আপস তো করতেই হচ্ছে বাংলাদেশের থিংক ট্যাংককে।
সাকিব একাই নন, চোটের কারণে এ সিরিজে নেই মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন। তাতে এ পেসার অলরাউন্ডারের জায়গা একজন পেসারকে দিয়ে ভরাট করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। প্রায় তিন বছর পর জাতীয় দলে ফেরা আল-আমিন হোসেনে আপাতত সাইফের বিকল্প দেখছে বাংলাদেশ। প্রায় একই ব্যবধানে ফেরা আরাফাত সানির বাঁহাতি স্পিনে সাকিবের ছায়া খুঁজছে সফরকারীরা।
বায়ুদূষণ, সন্ধ্যার কুয়াশা নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে ভারতকেও। নিয়মিত অধিনায়ক বিরাট কোহলির এ সিরিজ বিশ্রাম নেয়া কিংবা হার্দিক পাণ্ডের চোট—কোনোটাই সুখবর নয় রোহিত শর্মার জন্য। তবে স্বাগতিক অধিনায়কের জন্য বরাদ্দ অনুপ্রেরণা তাঁর দুর্দান্ত একটি রেকর্ডে। ভারতের প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের নেতা মহেন্দ্র সিং ধোনির একটি অর্জন এ সিরিজেই ছুঁয়ে ফেলতে পারেন রোহিত। শিরোপা জয়ে এ ফরম্যাটে ভারতের সেরা ধোনি। তবে বাংলাদেশকে হারাতে পারলেই ধোনির সমান শিরোপা জেতা হয়ে যাবে রোহিত শর্মার।
এটাকে কেউ চাঁদ ছোঁয়ার মতো দূরের স্বপ্ন বলে মনে করছেন কি? ঘরের মাঠে রোহিত শর্মার ধোনির রেকর্ডটা এবারই ছুঁয়ে ফেলা নিয়তি মনে করছেন যে সাংবাদিকরা, গতকালের ম্যাচপূর্ব সংবাদ সম্মেলনের পরে তাঁদের মনে করিয়ে দিয়েছেন রোহিত, ‘আমরা দুই কিংবা চার নই, টি-টোয়েন্টিতে র্যাংকিংয়ে আমরা পাঁচ নম্বরে। আমি হোমওয়ার্ক করি!’ যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করেন বলেই বাংলাদেশকে উড়িয়ে দিয়ে সিরিজ জয়ের ঘোষণা দিল্লিতে বসেই দেননি ভারত অধিনায়ক। বরং সমীহই ঝরেছে তাঁর কণ্ঠে।
সাকিবহীন ক্রিকেট শুরুর দোরগোড়ায় আপাতত এটুকুই প্রশান্তির— পরিস্থিতি যা-ই হোক, প্রতিপক্ষ অধিনায়ক তো পর্যাপ্ত সম্মান ঠিকই দিয়েছেন। সেটা বজায় রাখা মাহমুদদের দায়িত্ব। সরু টানেলে আশার ক্ষীণ আলো হয়ে উঁকি দিচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেই পুরনো ধারা—দুঃসময়েই সেরা ক্রিকেট খেলার!