সাত কলেজের অহেতুক অধিভুক্তি - Dainikshiksha

সাত কলেজের অহেতুক অধিভুক্তি

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

নামে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলেও নানা কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দিন দিন তার জৌলুস হারাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা এখানে ভর্তি হয়ে শুরু থেকেই বিসিএসের গাইড কিনে পড়েন। সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব নিয়ে তারা বৃহত্তর পরিসরে গভীর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অধ্যয়ন করতে চান না। শুধু বিসিএস গাইড মুখস্থ করেই তাদের শিক্ষাজীবন কেটে যায়। এই যখন বাস্তবতা, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং এর অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জীবনে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে; যদিও এর কারণটি একেবারে নতুন নয়। সোমবার (২২ জুলাই) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত  এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন শেখ আদনান ফাহাদ।

অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা নিজেদের শিক্ষাজীবন নিয়ে অসীম অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। এরা মাঝেমধ্যেই রাস্তায় নামছেন। নিজের শিক্ষাজীবনের নিরাপত্তা চাইতে গিয়ে চোখ হারানো সিদ্দিকুরের কথা আমরা হয়তো ভুলে গেছি। সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা আমরা ভুলে গেলেও সিদ্দিকুর বা তার মা ভুলবেন না; আমৃত্যু অভিশাপ দিয়ে যাবেন সেই বড় মানুষদের, যারা তার শিক্ষাজীবন ও পরবর্তী জীবনও ধ্বংস করে দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল দাবিতে সাত কলেজ এবং খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও রাস্তায় নেমেছেন আবার। শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো.আখতারুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেছেন, 'সাত কলেজ অধিভুক্তির বিষয়টি এককভাবে ঢাবির সিদ্ধান্ত নয়। এটি একটি জাতীয় সিদ্ধান্ত। অধিভুক্তির কারণে যে বিদ্যমান সমস্যা, তা সমাধানের কাজ চলছে। এ জন্য সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে।'

উপাচার্য কীভাবে এ সমস্যার সমাধান করবেন, আমাদের জানা নেই। তবে বাস্তবতার নিরিখে সবচেয়ে সহজ ও একমাত্র কার্যকর সমাধান হচ্ছে, এই অধিভুক্তি বাতিল করে আগের পদ্ধতিতে কলেজগুলোকে ফিরিয়ে নেওয়া। সাতটি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত- এটা শুনতে বা বলতে যত আরামবোধ হয়, বাস্তবে ঠিক এর উল্টো। এটি এখন সংশ্নিষ্ট সবার গলার কাঁটা। কাঁটা রেখে কোনো সমাধান কেন হবে না- সেটি বাস্তবতার নিরিখে বিচার করলেই পরিস্কার হবে।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নীলিমা আখতার বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি করছেন। তিনি ফেসবুকে এ ব্যাপারে তুলে ধরে একটি পোস্ট দিয়েছেন। এখানে তার অংশবিশেষ তুলে ধরছি। নীলিমা আখতার লিখেছেন, 'সাত কলেজ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আবার রাস্তায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামর্থ্য এবং উদ্দেশ্যের সাথে সাত কলেজ যায় না। আমাদের নিজেদের ছাত্রদের কতটুকু দিতে পারছি আমরা? পাবলিক প্রতিষ্ঠানের অনেক সীমাবদ্ধতা। নিজেদের চল্লিশ হাজার ছাত্রকে ভালো শিক্ষা দেয়াই কঠিন, তার উপর সাত কলেজের পৌনে দুই লক্ষ ছাত্রের তত্ত্বাবধান। এটা কি আমাদের পক্ষে সম্ভব, না আমাদের করার কথা? চল্লিশ হাজার ছাত্র নিয়েই কিন্তু আমরা প্রায় ম্যাসের প্রতিষ্ঠান, তার উপর পৌনে দুই লক্ষ! ম্যাসকে শিক্ষা দেয়া আমাদের কাজ নয় কিন্তু। সবচেয়ে যোগ্যদের জীবনের জন্য, সমাজের জন্য, দেশ গঠনের জন্য তৈরি হতে সাহায্য করা আমাদের কাজ। আর কাজ গবেষণা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ সাত কলেজ নিয়ে খুশি, তা আমার মনে হয় না। অতীতে নেয়া সিদ্ধান্ত এবং সরকারের ইচ্ছাটাই এখানে প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়েছে সরকারি ইচ্ছার গ্যাঁড়াকলে। এভাবে সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিগ্রস্ত করা সরকারের উচিত হচ্ছে না। সাত কলেজের ছাত্রদের অবস্থা দেখুন। ওরা যাই হোক একটা নিয়মের ভেতর ছিল। আমাদের কাছে এসে সেশনজটে পড়ল। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা গবেষণা করার যৎসামান্য সুযোগটাও হারাচ্ছি।' 

নীলিমা আখতারের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করার কোনো সুযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। নামে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কলেজ পর্যায়ে খুব বেশি হওয়ার কথা নয়। কলেজে ক্লাস হবে, পরীক্ষা হবে, ছেলেমেয়েরা পাস-ফেল করবে; এখানে গবেষণার কাজটি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের মতো করে হয় না; হওয়ার কথা না। কলেজগুলো চালানোর জন্য মন্ত্রণালয়ের অধীন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা-শিক্ষকরা আছেন। তাদের কাজটি যখন বিশেষ কোনো ইলিউশনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনা হয়, তখন এর যৌক্তিক ভিত্তি খুব শক্তিশালী হয় না। বাংলাদেশ যেহেতু জ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্র নয়; একটি আমলানির্ভর রাষ্ট্র, সেহেতু এখানে গবেষণা বা গবেষকের মূল্যায়ন হয় না। সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফারুকের প্রতি করা এক সচিবের অবৈজ্ঞানিক আচরণ আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানহীনতার বাস্তবতাকেই নির্দেশ করে। তবে যারা নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও গবেষণা করতে চান, তাদের জন্য কলেজের লাখ লাখ ছেলেমেয়ের খাতা দেখা, মার্কস দিয়ে রেজাল্ট দেওয়ার কাজ কোনোভাবেই সুখকর কোনো অভিজ্ঞতা নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কলেজগুলোতে গিয়ে ক্লাস নেন না, অনুশীলনী পরীক্ষা নেন না; শুধু চূড়ান্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠানের নিমিত্তে পরীক্ষা কমিটি গঠন, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, পরীক্ষা গ্রহণ করে খাতা মূল্যায়নের কাজ করেন, ভাইভা নেন। সাত কলেজের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যোগাযোগ হয় না বললেই চলে। এমন যোগাযোগহীন বাস্তবতায় ঢাবির শিক্ষকরা যদি প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেন এবং খাতা মূল্যায়ন করেন, তাহলে তার ফলাফল অনাকাঙ্ক্ষিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের নিজেদের শিক্ষার্থীদের মেধার ও খাতার মান নিয়েই অনেকক্ষেত্রে সন্তুষ্ট নন। নানা কারণে সাম্প্রতিককালে সারাদেশে শিক্ষার্থীদের মান পড়ে গেছে। সেখানে কলেজের পরীক্ষার্থীদের খাতা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দেখবেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই পাস করবে কমসংখ্যক ছেলেমেয়ে। কলেজে নিশ্চয় দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়েরা ভর্তি হয়নি। তবে কলেজে উচ্চশিক্ষার্থে ভর্তি হওয়া ছেলেমেয়েরাও যথেষ্ট মেধাবী। কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতা, কলেজগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণে ভালো বইয়ের অভাব, আধুনিক গ্রন্থাগারের অভাব, সিলেবাস মেনে পাঠ কার্যক্রম পরিচালনা না করা ইত্যাদি নানা কারণে কলেজের মেধাবী ছেলেমেয়েগুলো ঠিকঠাক প্রস্তুতি নিতে পারে না। এমন বাস্তবতায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যদি কলেজের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রশ্ন করেন আর খাতা মূল্যায়ন করেন, সেখানে বিপর্যয় আসতে বাধ্য। 

কলেজের ছেলেমেয়েদের প্রশ্ন কলেজের শিক্ষকরাই করবেন, খাতা দেখে ফলও তারা দেবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হলেই কলেজের পড়ালেখায় বিরাট পরিবর্তন চলে আসবে; এটা ভেবে পুলক অনুভব হলেও বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের ছেলেমেয়েদেরই জীবন কতটা পাল্টাতে পারছে? তাই প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আমাদের আকুল আবেদন, অধিভুক্তির সিদ্ধান্ত আবার বিশ্লেষণ করা হোক, জোড়াতালি দিয়ে একটি সিস্টেম চালু রাখার চেয়ে বাতিল করে পুরনো সিস্টেমে ফিরে যাওয়া শ্রেয়।

 

লেখক:  জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0049090385437012