সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন - Dainikshiksha

সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন

আকমল হোসেন |

পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলের প্রথমদিকে এই ভূখণ্ডে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ছাত্ররাই ছিল লড়াকু ও অগণী ভূমিকায়। ছাত্র অধিকার, সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকার অধিকার এবং জাতীয় অধিকারে তাদের সোচ্চার হতে দেখা গেছে। এখনও দেখা যায়, তবে আগের মতো জোরালো ও শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে নয়। আরেকটি ব্যতিক্রমী ঘটনা হচ্ছে, আগে এসব আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখত ছাত্র সংগঠনগুলো। তবে সব ছাত্র সংগঠনই যে এমন কাজ করত, তা নয়। ছাত্র সংগঠনগুলো একসময় ছিল তাদের স্বাধীন অবস্থান থেকে ছাত্র সমাজের শিক্ষা-সংস্কৃতি সংক্রান্ত দাবি-দাওয়া নিয়ে সোচ্চার। এর পর জাতীয় বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে এবং জাতির জন্য করা প্রয়োজন এমন সব দাবি নিয়ে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ বরাবর চাপ সৃষ্টি করত প্রেশার গ্রুপ হিসেবে। 

১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোকে অন্তঃসারশূন্য, ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ, তার পর থেকে অদ্যাবধি ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় রাজনীতির গতি-প্রকৃতির কারণে ছাত্র রাজনীতির বৈশিষ্ট্য আলোচনা করলে মোটা দাগে তিনটি বিষয় পরিস্কার। ১৯৫২-১৯৭০-এর ছাত্র আন্দোলনের স্বকীয় অবস্থান নিজস্ব অধিকারভিত্তিক আন্দোলন। পাশাপাশি জাতীয় ইস্যু নিয়ে স্বাধীন অবস্থান থেকে আন্দোলন। এগুলোর মধ্যে ভাষা রক্ষার আন্দোলন, সামরিক শাসনবিরোধী ৬ দফা ও ১১ দফাভিত্তিক আন্দোলন এবং ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্দোলন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশ গঠনের আন্দোলন। 

সামরিক শাসক দ্বারা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন ও ছাত্র সমাজকে ওইসব রাজনৈতিক দলের হুকুমের গোলাম করা হয়। আর্থিক ও বৈষয়িক সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু হয়। ছাত্র রাজনীতির মূল স্রোতধারায় আদর্শের বিচ্যুতি ঘটতে শুরু করে। ছাত্র অধিকার আদায়ে ছাত্র আন্দোলন রচনার বিপরীতে ছাত্র সংগঠনগুলো স্বাধীন অবস্থান হারিয়ে রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ছাত্র সংগঠনগুলোর গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন আসে বা ওই গঠনতন্ত্রগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে। এ ধারাতে ১৯৭৫ সালের পর ছেদ ঘটে। কর্মীর সংখ্যা বিচারে বৃহৎ ছাত্র সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলের হুকুমের গোলামে পরিণত হয়। ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদে শুধু ছাত্র সংগঠনগুলো ছাত্র সমাজের সমস্যা ভুলে ক্ষমতাসীন দলের উন্নয়নের ফিরিস্তির জপমালা গাইতে শুরু করে। ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার নিরাপত্তার লাঠিয়াল হিসেবে জনগণের অর্থে পালিত পুলিশ আর আমলাতন্ত্রের মতোই ছাত্র সংগঠনগুলো ব্যবহার হতে থাকে। সে কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা অথবা অনেক জনপ্রতিনিধি ছাত্র-জনতার ন্যায়সঙ্গত দাবির আন্দোলনকে দমন করতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনকে ব্যবহার করেন। লাঠিসোটা, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে অধিকারবঞ্চিতদের আন্দোলন দমনে। আর প্রধান বিরোধী দল, যারা এক সময় ক্ষমতায় ছিল তাদের আশীর্বাদপুষ্ট ছাত্র সংগঠন ছাত্রদের অধিকার ভুলে সরকার পতনের আন্দোলনে আগুয়ান হয়। অতীতে পাওয়া সুবিধার স্মৃতি তাদের মনকে চাঙ্গা করে হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও আর গণতন্ত্র রক্ষায় জীবনপাত করে। কেউ ব্যবহার হয় ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতাকে নিরাপদ করতে, আর কেউ শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করে বিরোধী শক্তিকে ক্ষমতায় বসাতে। তাদের সৃষ্ট আন্দোলনের কারণে বাস্তুচ্যুত হয় অর্থাৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আবাসিক হলের সিট হারায়। মেধা তালিকায় সিট থাকলেও তাতে থাকতে পারে না, অথবা তাদের থাকতে দেওয়া হয় না। আরও মজার ব্যাপার, বিশ্ববিদ্যালয় ও বৃহৎ কলেজগুলোর ছাত্রাবাসে অর্থের বিনিময়ে আসন বরাদ্দ দেয় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র নেতৃবৃন্দ। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের শাসকরা নীরব থাকেন। 

ক্ষমতাকেন্দ্রিক ছাত্র রাজনীতি চর্চার দৃশ্যমান ফলাফল হলো, এই ছাত্র সংগঠনগুলোর কর্মীরা খুনোখুনি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অপহরণ, ধর্ষণ, শিক্ষক লাঞ্ছনা, প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা লাভজনক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। বিদ্যমান এই বাস্তবতায় ছাত্রছাত্রীদের দৈনন্দিন জীবনের নানামুখী সমস্যা সমাধানে সাধারণ ছাত্রছাত্রী, পেশাজীবী সংগঠন অথবা বাম ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে কোনো আন্দোলনের সূচনা ঘটলে তার ওপর হামলা আসে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে এবং সরকার নিয়োজিত দলীয় স্বার্থ রক্ষাকারী দলদাস এসব প্রতিষ্ঠান-প্রধান আন্দোলনকারীদের দমাতে ওই লাঠিয়ালদের ব্যবহার করেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সব সময় যেন একভাবে এই সংস্কৃতির চর্চা হয়েছে। এটা কোনো ভালো লক্ষণ নয়। কথায় বলে, পরের চালে ঢিল দিলে নিজের চালে পাটকেল পড়ে। এ প্রবাদের বাস্তব প্রতিফলন দেশবাসী দেখেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কারের আন্দোলন অথবা ঢাকা শহরের ৭টি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত করা, দেরিতে ফল ঘোষণাজনিত আন্দোলন অথবা চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধিজনিত সৃষ্ট আন্দোলনকে দমাতে অধিকাংশ জায়গাতেই সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের হামলা, কোথাও পুলিশি হামলা ঘটেছে। এগুলো ছিল শ্রেণি-পেশার মানুষের পেশাগত সমস্যা সমাধানের আন্দোলন।

এটি কোনোভাবেই সরকারবিরোধী বা সরকার পতনের আন্দোলন ছিল না। তাহলে কেন এবং কোন যুক্তিতে এই আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা ও মামলা হলো? গণতন্ত্রের দেশে এ প্রশ্ন করা এবং এর উত্তর চাওয়া নিশ্চয় অযৌক্তিক নয়। অপরাধের শাস্তি এবং ভালো কাজের পুরস্কার না থাকলে সেখানে ভালো চিন্তা ও কাজের মানুষ সৃষ্টি হবে না। পাকিস্তান আমলেও শুধু নকল করার অপরাধে ছাত্র সংগঠনের অনেক কর্মকে ওই ছাত্র সংগঠন থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। আর আজ? ধর্ষণকারী, চাঁদা আদায়কারী, খুনিদের ছাত্র সংগঠনের বড় পদে বসানো হয়। ছাত্র রাজনীতিতে নেতাদের যোগ্যতা ভালো ছাত্র হওয়া, বিনয়ী স্বভাবের হওয়া অথচ আজ আর সন্ত্রাসে পারদর্শিতাই যেন ছাত্রনেতা হওয়ার যোগ্যতা। ছাত্র না হয়েও অথবা আদুভাইদের ছাত্রনেতা বানানোর যে সংস্কৃতি শুরু হয়েছে সেখানে ছাত্র রাজনীতির সুস্থ ধারা কীভাবে বিকশিত হবে- সে প্রশ্ন সচেতন মানুষের। ছাত্রনেতারা আজ হেলিকপ্টারে চড়ে প্রোগ্রামে যায়। আলিশান জীবন-যাপন ও বাহারি গাড়ি ব্যবহারের উৎস বের না করলে ছাত্র রাজনীতির এই শনির দশা কাটবে না। 

ইদানীং ছাত্র অধিকার নিয়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ব্যানারে আন্দোলন-সংগ্রাম হতে দেখা যাচ্ছে। পাকিস্তান আমলেও যা ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে হতে দেখা যেত। বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোও যেন সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারছে না। ছাত্র সংগঠনগুলোকে ছাত্রদের দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে-ময়দানে যেভাবে থাকার কথা, সেটি আগের মতো হচ্ছে না। ছাত্র রাজনীতির এই দুর্বলতা না কাটলে অধিকার আদায়ের আন্দোলন বেগবান হবে না। কারণ দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন ছাড়া পুঁজিবাদী ভোগবাদী এবং ক্ষমতালোভী শাসকদের কাছ থেকে ছাত্রসমাজ ও জনতার দাবি আদায় করা সম্ভব নয়। বিষয়টি ছাত্রনেতৃত্বকে ভেবে দেখতে হবে। ছাত্র রাজনীতি স্বচ্ছ না হলে জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্বের ঘাটতি মিটবে না।

১৯৭২ সালে ছাত্রলীগে বিভক্তি, জাসদ গঠন, জাসদ ও আওয়ামী লীগের মুখোমুখি সংঘাতময় অবস্থান এবং ১৯৭২ সালে ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধানের নেতৃত্বে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে ছাত্রলীগের অপর  অংশের ৭ জন ছাত্রের হত্যাকাণ্ড ছাত্র রাজনীতির স্বাভাবিক ও ইতিবাচক গতিপ্রবাহে আঘাত হানে। ১৯৭৫ সালের পর সামরিক বাহিনীর লোকজন ক্ষমতা দখল এবং ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ছাত্র সংগঠনকে  ব্যবহার শুরু করলে ছাত্র আন্দোলনের পূর্বের ইতিবাচক ধারাটি বিলুপ্তির পথে ধাবিত হয়। ফলে সংগঠনগুলোতে নিয়মিত  সম্মেলন না হওয়া; অছাত্র ও সন্ত্রাসে বিশ্বাসী ও পারদর্শীরা বৃহৎ ছাত্র সংগঠনের মূল নেতৃত্বে আসার সুযোগ পায়। স্বাভাবিক শাসনামলে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ, ছাত্র সংসদ নির্বাচন এবং সংগঠনগুলোর নিয়মিত সম্মেলন না হওয়ায় সন্তানের বাবাও অর্থাৎ আদুভাই ছাত্রনেতা পয়দা হতে থাকে। 

সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ , শিক্ষক সমিতি

সূত্র: সমকাল

 

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032620429992676