সান্ধ্যকালীন কোর্স বাতিলের সিদ্ধান্ত সময়োচিত - দৈনিকশিক্ষা

সান্ধ্যকালীন কোর্স বাতিলের সিদ্ধান্ত সময়োচিত

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন বাণিজ্যিক কোর্স বাতিলের দাবিটি বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর অনেক পুরোনো একটি দাবি। নিছক একটি দাবি বললে ভুল হবে, এটি তাদের একটি দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন। বলতে পারি, এই বাণিজ্যিক শিক্ষার বিস্তারের শুরু থেকেই তারা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। এতদিন পর আজ যখন আমাদের রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য নিজেই এই বাণিজ্যিক কোর্স বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছেন, তখন আচার্যের সঙ্গে বামপন্থি এই ছাত্র সংগঠনগুলোকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। ধীরে ধীরে  ধর্মীয় ছাত্র রাজনীতির উত্থান ও বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর সংকোচনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণ ছাত্রদের দাবি আদায়ের আর কোনো মঞ্চ থাকল না। সে সুযোগেই এই ব্যবসায়িক কোর্সগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশি বিস্তার করেছে। যে সংগঠনের শুরুটাই কোচিং সেন্টার ও ধর্ম ব্যবসা, সেটি তো কোনোভাবেই সাধারণ ছাত্রদের স্বার্থরক্ষার মঞ্চ হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় শিক্ষকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া ও আদর্শিক শিক্ষকের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর এই আন্দোলনটা কিছুটা মলিন হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু হারিয়ে যায়নি। তার প্রমাণ সম্ভবত আমরা অচিরেই পেতে যাচ্ছি। শনিবার (১৪ ডিসেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত  এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সান্ধ্যকালীন কোর্স বাতিলের সিদ্ধান্তকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিন্ন নীতিমালার বিরোধিতার আলোকে দেখা উচিত হবে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমরা ইউজিসির অভিন্ন নীতিমালার বিরোধিতা করি; কারণ এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল বৈশিষ্ট্য স্বায়ত্তশাসনকে অস্বীকার করে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন কোর্স বাতিলের সিদ্ধান্তটিকে কোনোভাবেই স্বায়ত্তশাসনের ওপর হস্তক্ষেপ মনে করা উচিত হবে না। সান্ধ্যকালীন কোর্স বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনকে কোনোভাবেই সমৃদ্ধ করে না, বরং অপমান করে। অন্যভাবে বলা যায়, সান্ধ্যকালীন কোর্স স্বায়ত্তশাসনের একটি মারাত্মক অপব্যবহার। আমাদের মনে রাখতে হবে, অপব্যবহার হয়ে কোনো ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। স্বায়ত্তশাসন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক ও আদর্শিক বৈশিষ্ট্য। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও সাধারণ-নিয়মিত ছাত্রদের বঞ্চিত করে সান্ধ্যকালীন কোর্সকে আমরা একটি অনৈতিক ব্যবসা মনে করি, যা বাংলাদেশের চাকরি বাজারকেও মারাত্মকভাবে অস্থির করে তুলেছিল। নিয়মিত কোর্সের বাইরে কিছু শর্টকোর্স বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই পারে। তাই বলে নিয়মিত ছাত্র ও গবেষণাকে উপেক্ষা করে নয়। অতিরিক্ত কোর্সগুলোকেও বরং নিয়মিত ছাত্র ও গবেষণাকে সমৃদ্ধ করতে হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন কোর্সগুলো একদমই তা নয়। একমাত্র ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে এগুলো ডিজাইন করা হয়েছে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন অনুষদ মূলত এই কার্যক্রম শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে সৃষ্ট আয়বৈষম্যের সাধারণ তত্ত্বে, এটি অন্যদের বা অন্যান্য অনুষদকেও মারাত্মকভাবে আক্রান্ত করেছে। সেটাই স্বাভাবিক, ঢালু জায়গায় পানি স্থির থাকে না, গড়ায়। হ্যাঁ, মানছি যে আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আর্থিকভাবে খুব ভালো মূল্যায়ন করা হয় না। সরকারি কর্মকর্তারা বরং অতিরিক্ত অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। তাই বলে জাতির বিবেক শিক্ষক হিসেবে আমরা এ রকম একটা অনৈতিক ব্যবসায়িক পথ ধরতে পারি না; অর্থনৈতিক জীবনমান বাড়াতে গিয়ে আদর্শিক মানকে বিসর্জন দেওয়া! আমরা বরং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে আমাদের সুযোগ-সুবিধা আদায় করার জন্য আন্দোলন করতে পারি। সেখানে আমরা নিশ্চিত সাধারণ ছাত্রদের সহযোগিতা পাব। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের কেউ বলতে পারেন, সরকার আমাদের গুরুত্ব দেয় না। তাদের বলি, পাকিস্তান সরকার আমাদের গুরুত্ব না দিয়ে রাজাকারদের গুরুত্ব দিয়েছিল বলে আমরা সবাই দলে দলে রাজাকার হয়ে যাইনি। তা-ই যদি হতো তাহলে দেশটা স্বাধীন হতো না। আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজেরা নিজেদের অবস্থানে ঠিক থাকলে সরকার গুরুত্ব দিতে বাধ্য। যেমন আমাদের আন্দোলনের কারণেই সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনবিরোধী  অভিন্ন নীতিমালাটি এখনও বাস্তবায়ন করতে পারেনি।

ব্রিটিশ সরকারের বৈষম্যমূলক বেতন কাঠামোর প্রতিবাদ বাঙালি বিজ্ঞানী ও কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক জগদীশ চন্দ্র বোস নিজে একেবারে বেতন নেওয়া বন্ধ করে দিয়েই করেছিলেন। এই অজুহাতে তিনি কোনো করপোরেশনের কাছে বিক্রি হননি বা অন্য কোনো অনৈতিক পন্থা অনুসরণ করেননি। তাই হয়তো তিনি সফল হয়েছিলেন। এরিয়ারসহ প্রাপ্য বেতনও ফেরত পেয়েছিলেন। আমরা যদি সাধারণ-নিয়মিত ছাত্রও মূলত শিক্ষা কার্যক্রমকেই অস্বীকার করব, তাহলে তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল চরিত্রটিই থাকল না! বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্যকে উদাহরণ করে আমরা কোনোভাবেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন কোর্সকে সমর্থন করতে পারি না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্যকে আমরা যে সান্ধ্যকালীন কোর্সের যুক্তি হিসেবে দাঁড় করাই, এতে আমাদেরই লজ্জা হওয়া উচিত। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষাবাণিজ্য প্রতিষ্ঠায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই বেশি দায়ী।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকালীন কোর্স না থাকলে ছাত্ররা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাবে- এমন একটা খোঁড়া যুক্তি কোর্স সমর্থনকারীরা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাবে না তারা অন্য কোথায় গেল, সেটা ভাবা আমাদের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। এই ব্যবসায়িক ডিগ্রিগুলোর ভাগ্য গুণগত শিক্ষার চাহিদা-জোগানের সংশ্নেষণেই নির্ধারিত হবে- এ নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে না। এই তো ক'দিন আগেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন অনুষদে প্রথম বর্ষ ভর্তি পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি আবেদন পড়ত। বিজ্ঞান অনুষদে আবেদনকারীর সংখ্যা অনেক কম ছিল। গত কয়েক বছর ধরে সংখ্যাটা ঠিক উল্টে গেছে; বিজ্ঞান অনুষদে আবেদনকারীর সংখ্যা ব্যবসা প্রশাসনের চেয়ে অনেক বেশি পড়ছে। আমাদের চাওয়ায় কিন্তু এই প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ হয় না।

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় তো আর আকাশ থেকে পড়েনি। আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই ওই প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করেছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ও মেধাবী ছাত্রদের বঞ্চিত করে শুধু অর্থের জন্য আমরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছি। পূর্বসূরিদের কিছুটা দায় আমাদের তো নিতেই হবে। এত ব্যবসায়িক ডিগ্রির প্রয়োজনীয়তা আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই প্রথম তৈরি করেছে। আমরা তৈরি করেছি বলে এটা সবসময় আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, এটা ভাবার কোনো সুযোগ নেই। এটা তো ঠিক, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় যত পরিপকস্ফ হবে, সেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের খেপ মারার সুযোগ ততই কমবে। অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নির্দিষ্ট দেশের পিএইচডিধারীকে শুধু শিক্ষক হিসেবে গ্রহণ করে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন কোর্সের শিক্ষকরা পিছিয়ে পড়বেন, এটাই স্বাভাবিক। এর জন্য মায়াকান্না করে কোনো লাভ নেই। তাদের বরং নিজেদের নিয়মিত ছাত্রদের গুরুত্ব দেওয়া ও হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনা উচিত। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উচিত সান্ধ্যকালীন কোর্স বাতিলের সিদ্ধান্তটিকে বাস্তবায়নে আমাদের রাষ্ট্রপতি ও ইউজিসিকে সহযোগিতা করা।

লেখক: আলতাফ হোসেন রাসেল, শিক্ষক, পরিসংখ্যান বিভাগ
কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.027492046356201