সুস্নিগ্ধ ধীমান আহমদ রফিক - দৈনিকশিক্ষা

সুস্নিগ্ধ ধীমান আহমদ রফিক

সৌমিত্র শেখর |

আজ আহমদ রফিকের জন্মদিন, তাঁকে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জানাই। শ্রদ্ধা জানাই কারণ তিনি অগ্রজ, ভালোবাসা জানাই কারণ তিনি আমার অন্তরের অগ্রগণ্য মানুষদের একজন। তিনি আরো বহুদিন সুস্বাস্থ্য ও সক্ষমতার সঙ্গে কাজ করে যান—আজ এ সুন্দর মুহূর্তে এটাই প্রধান চাওয়া।

আহমদ রফিকের কয়েকটি পরিচয় আমাদের সবারই জানা। তিনি ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক ও অনুরাগী, প্রাবন্ধিক এবং সবচেয়ে বড় কথা তিনি উদার, অসাম্প্রদায়িক বিশিষ্ট বাঙালিজন। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন ঢাকার নিউ মার্কেটে ‘বিদ্যাসাগর’ নামের একটি বইয়ের দোকানে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। সেটি গত শতকের আশির দশকের কথা। ‘রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র’ নামে ছোট একটি সংগঠনের কিছু কাজকর্মের সংবাদ উৎসাহী হিসেবে পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছিলাম। তিনি ছিলেন সেই কেন্দ্রের হৃৎপিণ্ড। বইয়ের দোকানে এই পরিচয়ের সূত্রে তাঁর প্রতি আমার আগ্রহও বেড়ে গিয়েছিল। তিনি আমাকে পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের ঠিকানায় সাহিত্য-সংস্কৃতিবিষয়ক কথা লিখে চিঠিও দিয়েছিলেন। কিন্তু তখন ছিল স্বৈরাচারী এইচ এম এরশাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকাল। সব কিছুর মতো সে চিঠিও ঠিকানা হারিয়েছিল। তবে মেধাবী এ মানুষটি আমার মতো সামান্য মানুষকে মনে রেখেছিলেন, আমিও দূর থেকে তাঁর লেখার একনিষ্ঠ পাঠকে পরিণত হয়েছিলাম। তখন সবে তাঁর ‘ছোটগল্প : পদ্মাপর্বের রবীন্দ্রগল্প’ (১৯৮৭) বইটি বেরিয়েছে আর আমরা ক্লাসে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প পড়ছি। প্রথাগত রবীন্দ্রস্তুতি বা রবীন্দ্রবিদ্বেষী বইগুলোর বাইরে রবীন্দ্রনাথকে মানবতাবাদী মার্ক্সীয় দৃষ্টিতে দেখার যে প্রয়াস আহমদ রফিক দেখিয়েছিলেন, সেটিই আমার দৃষ্টি খুলে দিয়েছিল এবং আমি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিটি আত্মস্থ করতে চেয়েছিলাম। রবীন্দ্রনাথ ও পূর্ববঙ্গবিষয়ক কথকতাবিষয়ক তাঁর লেখা পড়েই প্রথম ভালোভাবে জেনেছিলাম, বাংলাদেশে না এলে আমরা এই রবীন্দ্রনাথকে পেতাম না। শ্রমজীবী মানুষের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করে রবীন্দ্রনাথের লেখাগুলোর প্রতি প্রথম আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ডা. এম এ ওয়াদুদ আর দ্বিতীয়জন হিসেবে দূরে থেকে যিনি এ কাজ করেন তিনিও ডাক্তার—ডা. আহমদ রফিক। আহমদ রফিকের আছে একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, এটি তিনি প্রয়োগ করেছেন জীবনে, সাহিত্যেও। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর একাগ্রতা একটু বেশি হলেও কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যের উপযোগিতা এবং তা কিভাবে আমাদের সমাজজীবনে সঞ্চারিত করা যায়, এ নিয়ে তিনি গ্রন্থ রচনা করেছেন। ‘নজরুলকাব্যে জীবনসাধনা’ বা ‘বাংলা বাঙালি আধুনিকতা ও নজরুল’ গ্রন্থে নজরুলের যথাযোগ্য মর্যাদা না পাওয়ার ব্যাপারটি তিনি তুলে ধরেছেন। নজরুল ধর্মকে যেভাবে ব্যবহার করেছেন, সেটি ভালো করে না বুঝেই বাঙালি পাঠক নজরুলকে যে নানা অভিধায় অভিহিত করেছে, তা নিয়ে আহমদ রফিকের আকর্ষণীয় পর্যবেক্ষণ আছে। বিষ্ণু দে বা তিরিশের কবিদের নিয়েও আছে তাঁর দারুণ পর্যবেক্ষণ ও উপস্থাপনা। ছিলেন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র, অভ্যাসবশত কিছু কবিতাও লিখেছেন বটে; কিন্তু বাংলা সাহিত্য পাঠ ও সমালোচনায় তিনি যে এমন দক্ষতার পরিচয় দেবেন, তা সত্যি অভাবিত ছিল। ১৯৯৭ সালে কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট আহমদ রফিককে ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধি প্রদানের মধ্য দিয়ে সাহিত্যের ওপর তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এই বিদগ্ধজনের যথাযোগ্য স্বীকৃতি প্রদানের সুযোগ নিল না। যদিও রাষ্ট্রীয় পদক ও পুরস্কার তাঁর হাতে উঠেছে, তবু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে স্বীকৃতি প্রদান সেই প্রতিষ্ঠানকেই মহিমান্বিত করবে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সুযোগ নেওয়ার দ্বার অবারিত, এই প্রস্তাব উপস্থাপন করছি। 

আমি কর্মসূত্রে ঢাকায় স্থায়ী হওয়ার পর এ মানুষটির সঙ্গে আমার হৃদ্যতা বাড়ে। তখন থেকেই তাঁকে দেখছি, এখনো দেখে চলেছি। জ্ঞান ও বিনয়ের সাক্ষাৎ অবতার তিনি। ‘মাটির মানুষ’ এমন অভিধা আমরা অনেক শুনেছি। ডা. আহমদ রফিকের সঙ্গে পরিচয় না হলে এর দৃষ্টান্ত বোধ করি অদেখাই থেকে যেত! যিনি যৌবনে ভাষাসংগ্রাম করেছেন, জীবনের মধ্যাহ্নে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সরবে-নীরবে কাজ করে গেছেন অব্যাহতভাবে, যিনি বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রদীপে শ্রম-অর্থ-সময় ব্যয় করে তৈল সরবরাহ করেছেন; কিন্তু কোনো কিছুর জন্য তাঁর বিন্দুমাত্র গর্ব নেই—তিনিই তো মাটির মানুষ! মাটির মানুষ এ কারণেও : মাটির গুণই হলো প্রতিবাদ করা। বিরুদ্ধতার বিপক্ষে কঠোর হওয়া। এটিও তিনি করেন। সাম্প্রদায়িক ও অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে তিনি যেভাবে আপসহীন থেকে একের পর এক লেখা লিখেছেন, তা এই মানুষটির নৈতিক দৃঢ়তাকেই প্রকাশ করে। বিদেশে থেকে এ বিষয়ে লেখা আর দেশে থেকে লেখা এক নয়। অনেকে বিদেশে অবস্থান করে এসব নিয়ে লিখছেন। সে লেখারও মূল্য অসীম। আহমদ রফিক দূর দেশে নয়, বিরূপ সমকালে স্বদেশে অবস্থান করেই তাঁর ক্ষুরধার লেখাগুলো লেখেন। এ যেন আগ্নেয়গিরির মুখে বসে অগ্ন্যুৎপাতের জ্বালার কথা লেখা! এমন সাহসী পথিকৃতের প্রয়োজন সর্বক্ষণ, তবে দুঃসময়ে আরো বেশি। আহমদ রফিক আমাদের দুঃসময়-পরিত্রাণের বাঁশিওয়ালা।

আহমদ রফিক রবীন্দ্রচর্চা প্রসারে শ্রম ও সময়ই শুধু নয়, অর্থও প্রদান করেছেন। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রচর্চার জন্য তিনি গড়ে দিয়েছেন নিজের সঞ্চয় থেকে তহবিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেগুলোর সবই যে কাজ করছে, তেমন নয়। রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র থেকে একটি পত্রিকাও কিছু দিন বের করেছেন। কিন্তু সেটিও বন্ধ। নিজে রাষ্ট্রভাষাসংগ্রামী বলে, ভাষা আন্দোলনের চেতনা সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে তিনি লেখালেখিতে খুব চেষ্টা করছেন—এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সাতচল্লিশের দেশভাগ ও তার পরের পরিস্থিতি নিয়ে নিজে মূল্যায়ন করে বাংলার আর্থ-সামাজিক বিকাশধারাটির নতুন প্রজন্মের কাছে নবালোকে তিনি নিয়ে এসেছেন। আহমদ রফিকের দৃষ্টিভঙ্গিটি উদার ও মানবতাবাদী। পাকিস্তান আমলে স্বদেশি মিলকারখানা স্থাপনের জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকে তিনি একটি ঔষধ কম্পানির পত্তনের সঙ্গে যুক্ত হন। প্রচুর অর্থ আয়ের জন্য এটি তিনি করেননি। তাই খানিকটা হলেও এ ব্যবসায় যখন অন্যায়ের সঙ্গে আপস করতে হবে বলে মনে হলো, তখন তিনি সেই কম্পানিই ছেড়ে দেন। ধন-সম্পদের পেছনে তিনি কখনো ছোটেননি, নিজের সঞ্চিত অর্থে ভালো কাজগুলো করেছেন সারা জীবন।

আহমদ রফিকের সঙ্গে অনেকগুলো আলোচনা অনুষ্ঠানে বসার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর আবাসস্থলে গিয়েও কথা বলেছি। এই মানুষটি চান লোভ, আত্মকেন্দ্রিকতা, পরশ্রীকারতা ত্যাগ করে বাঙালি সবাই ‘নবমানব’ হয়ে উঠুক। তিনি মনে করেন, প্রশান্তিই জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। মানবজীবনে যিনি সব পেলেন কিন্তু প্রশান্তি পেলেন না, তিনি অসুখী; আর তাঁর রাষ্ট্রও দুঃখী। তিনি আজীবন একটি সুখী ও কল্যাণকামী রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছেন এবং সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষদের তৈরি করতে চেষ্টা করেছেন। অর্থকষ্ট থেকে মুক্ত হয়ে মানুষের প্রশান্তিময় জীবন প্রতিষ্ঠাই সুস্নিগ্ধ ধীমান আহমদ রফিকের কল্যাণ রাষ্ট্রের মূল চেতনা।

লেখক : নজরুল অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: কালের কণ্ঠ

মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি - dainik shiksha মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! - dainik shiksha খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ - dainik shiksha এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা - dainik shiksha মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! - dainik shiksha মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003046989440918