স্কুল-কলেজে খামাখা কমিটি - দৈনিকশিক্ষা

স্কুল-কলেজে খামাখা কমিটি

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

স্কুল-কলেজে ম্যানেজিং কমিটি আর গভর্নিং বডি যাই বলি না কেন প্রকৃতপক্ষে এরা যেই লাউ সেই কদু৷ উভয়ের একই কাজ৷ কী এমন কাজ এদের? নিজের কাছে এমন প্রশ্ন করে কোনো উত্তর খুঁজে পাই না৷ ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দারের মতো ৷ কমিটির লোকজনের মিছেমিছি মোড়লিপনা আর মাতব্বরী দেখানোর মানসিকতা ছাড়া কিছু থাকে না৷ অস্বীকার করি না একটা সময়ে কমিটির খুব দরকার ছিল৷ নতুন স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং প্রতিষ্ঠার পর এমপিও না হওয়া পর্যন্ত আজও কমিটির প্রয়োজন আছে ৷ সরকারি অনুদান ও শিক্ষকদের বেতন-ভাতা না হওয়া পর্যন্ত কমিটি লাগে ৷ কমিটির লোকজন টাকা পয়সা ম্যানেজ করে দেয়৷ শিক্ষকদের বেতনের ব্যবস্থা করে৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তদারকি করে৷ চেয়ার-টেবিল, ডেস্ক-বেঞ্চ তৈরি করে দেয়৷ স্কুল-কলেজের ঘর-দোর বানিয়ে দেয়৷ শিক্ষক যোগাড় করে নিয়োগ দেয়৷ নতুন প্রতিষ্ঠানে কোনো ঝামেলা দেখা দিলে সামাল দেয়৷ দৌড়াদৌড়ি করে প্রতিষ্ঠানের অনুমতি ও স্বীকৃতি এনে দেয়৷ এমপিও পাইয়ে দেয়৷ পূর্বে এ উদ্দেশ্যে ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডি গঠন করা হতো৷ আজকালও তাই৷

প্রতিষ্ঠান এমপিও পেয়ে যাবার পর কমিটির আর কী কাজ-সেটি খুঁজে পাই না৷ দেন-দরবার আর শিক্ষকদের ওপর কর্তৃত্ব ফলানো ছাড়া তাদের কোনো কাজ নেই৷ কোনো কোনো জায়গায় এরা এমপিওর টাকায় ভাগ বসায় বলে শোনা যায়৷ অনেক জায়গায় সভাপতিকে শিক্ষকদের বেতন থেকে টাকা দেয়া লাগে, না দিলে বেতন বিলে স্বাক্ষর করেন না৷

মাননীয় শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল কমিটির ব্যাপারে খোলামেলা কথা বলেছেন৷ কমিটির লোকজন বেশির ভাগ অশিক্ষিত৷ শিক্ষকরা সুশিক্ষিত মানুষ৷ তাদের ওপর অশিক্ষিত লোকজন কর্তৃত্ব ফলায়৷ মাননীয় উপমন্ত্রী নিশ্চয় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে কথাটি বলেছেন৷ এটিই চরম বাস্তব সত্য কথা৷ বেশির ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এসব ঘটে চলেছে৷ এটি কেবল শিক্ষকদের জন্য অবমাননাকর নয়, শিক্ষাব্যবস্থার জন্য বড় কলঙ্কও বটে৷ কমিটির অশিক্ষিত লোকজনের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানে আর্থিক শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা থাকে না৷ শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে এরা অনেক জায়গায় অনেক তেলেসমাতি করে৷ টাকার বিনিময়ে কত জায়গায় অযোগ্য লোক শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে৷ আবার কত জায়গায় এরা যোগ্য লোকের কপাল পুড়িয়েছে৷ আজ সারা দেশে গণিত, ইংরেজি ও বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষকের আকাল৷ এর জন্য কমিটিগুলো দায় এড়াতে পারে না৷

ভাগ্যিস, এখন সহকারী শিক্ষক নিয়োগে কমিটির পছন্দ-অপছন্দের কিছু নেই৷ আমাদের সে আকাল বেশি দিন থাকবে না৷ প্রতিষ্ঠান প্রধান ও কর্মচারী নিয়োগে তাদের ক্ষমতা শিগগিরই খর্ব করা দরকার৷ তা না হলে কমিটির লোকজনের কারণে সব বিনাশ হয়ে যাবে৷ সৎ, দক্ষ ও কর্মঠ লোকেরা যদি প্রতিষ্ঠান প্রধান না হয় তবে তো সর্বনাশ৷ ভালো লোক টাকা-পয়সা খরচ করে আসতে চাইবে না৷ টাকা পয়সা দিয়ে অসৎ লোকেরাই নিয়োগ নিয়ে থাকে৷ কমিটির হাতে নিয়োগ থাকলে সেটিই সচরাচর হয়৷ প্রতিষ্ঠান প্রধান অসৎ ও অযোগ্য হলে গোটা প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে৷ কথায় বলে, স্কুল তেমন হেড মাস্টার যেমন৷ আসলেও তাই৷ স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা সবার ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য৷ স্কুল-কলেজ কিংবা মাদরাসা মূলত প্রতিষ্ঠান প্রধানের ওপর নির্ভর করে৷ প্রতিষ্ঠান প্রধান স্বচ্ছ হলে সব ঠিক৷ তা না হলে সব কিছু হ-য-ব-র-ল অবস্থায় চলতে থাকে৷ এই যেমন মাথায় পচন ধরলে যা হয় তা৷

এক সময় বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা কোনো বেতন পেতেন না, তারপর ২৫ টাকা, ৫০ টাকা, ৭৫ টাকা করে করে একদিন তারা শতাংশের হিসেবে বেতন পেতে শুরু করেন৷ এক সময় তারা ৪০ বা ৫০ শতাংশ বেতন সরকার থেকে পেতেন৷ সে সময় বেতনের বাদ-বাকি টাকা ম্যানেজ করে দেবার জন্য কমিটির দরকার ছিল৷ এই কিছুদিন আগেও শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা পুরোপুরি যখন কমিটির হাতে ছিল তখনও কমিটির প্রয়োজনীয়তা একেবারে কমে যায়নি৷ কিন্তু এখন সরকার বেসরকারি শিক্ষকদের শতভাগ বেতন দেয়৷ সামান্য হলেও বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, উৎসব বোনাস ইত্যাদি দেয়৷ এ বছর থেকে ইনক্রিমেন্ট ও বৈশাখী ভাতা দেয়া শুরু করেছে৷ শিক্ষক নিয়োগও অনেকটা এখন সরকারের হাতে৷ নিয়োগের জন্য কমিটি না হলেও চলে৷ অবশিষ্ট সব নিয়োগ এনটিআরসিএ নিয়ে নিলেই পারে৷ উপজেলা পর্যায়ে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার ও একাডেমিক সুপারভাইজার আছেন৷ তারপরও প্রতিষ্ঠান প্রধানের নেতৃত্বে একটি ছোটখাট তদারকি কমিটি করা যায়৷ এমতাবস্থায় ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডি থাকার কোনো দরকার পড়ে না৷

একেকটা ম্যানেজিং কমিটি কিংবা গভর্নিং বডি গঠন করতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়৷ কমিটির মেয়াদ দু' বছর৷ তা আবার মেয়াদ শেষের তিন মাস আগ থেকেই কমিটি গঠন সংক্রান্ত কার্যক্রম শুরু করতে হয়৷ অগত্যা নির্বাচন করতে হলে কত যে ঝঞ্জাট পোহাতে হয়৷ স্কুল-কলেজের কমিটি নির্বাচন এক জটিল কাজ৷ নির্বাচনকে ঘিরে এলাকায় দলাদলি ও গ্রুপিং হয়৷ তাতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ে৷ এমন অনেক স্কুল-কলেজ খুঁজে বের করা যাবে যারা কমিটি গঠন নিয়ে বছরের পর বছর মামলায় জড়িয়ে আছে৷ মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে এসব প্রতিষ্ঠানে এখন আর লেখাপড়া বলতে কিছু নেই৷

স্কুল-কলেজের কমিটিগুলো জায়গায় জায়গায় বেপরোয়া হয়ে ওঠে৷ ক্ষমতার অপব্যবহার করে৷ কোনো কোনো জায়গায় শিক্ষকদের পীড়ন করে৷ অসৎ কিংবা অসাধু প্রতিষ্ঠান প্রধান হলে তো কথাই নেই৷ কমিটির যোগসাজসে প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়৷ প্রতিষ্ঠান প্রধান বেপরোয়া হয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের নানা রকম নিপীড়ন ও নির্যাতন করে৷ কমিটির লোকজনের হাতেও কোনো কোনো সময় নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার হন৷ এমনকি প্রতিষ্ঠান প্রধান পর্যন্ত হেনস্তার শিকার হন৷

কমিটির ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির উদাহরণ দেবার জন্য দু'টি প্রতিষ্ঠানের নাম এ মুহূর্তে মনে পড়ছে৷ তার একটি নারায়ণগঞ্জের বন্দর পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয় ও অন্যটি ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসা৷ প্রথমোক্ত প্রতিষ্ঠানের কমিটির সভাপতি গত কয়েক বছর আগে প্রধান শিক্ষককে স্কুলে কানধরে উঠবস করতে বাধ্য করেছিল৷ কী দুঃসাহস তার! দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠানটির প্রধান এই সেদিন মাদরাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন হয়রানি করেছে৷ তারপর তার লোকজন দিয়ে মাদরাসায় পুড়িয়ে মেরেছে৷ সেই প্রিন্সিপাল সিরাজ উদ দৌলার নানা দুর্নীতির খবর বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে৷ কমিটিকে টাকা খাইয়ে জাল সনদে তার চাকরি হয়েছে৷ মাদরাসার টাকা মেরে সে লক্ষ কোটি টাকার মালিক হয়েছে৷ এভাবে আরও কত কিছু৷ কমিটির লোকজনকে হাত করে সে মাদরাসাটিকে একান্ত নিজের এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে৷ 

এ দুটো প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়৷ সারা দেশের নিশ্চয় আরও অনেক স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় হরহামেশা এ রকম ঘটনা ঘটে চলেছে৷ নারায়ণগঞ্জ ও ফেনীর প্রতিষ্ঠান দুটো এসবের প্রতিচ্ছবি মাত্র৷ যেখানেই কিছু ঘটে সে সবের কোনোটি আমরা জানতে পারি আবার কোনো কোনোটি জানতে পারি না৷ এ সব ঘটনা প্রবাহ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কমিটির অসারতা সহজেই ফুটে উঠে৷ মাননীয় শিক্ষা উপমন্ত্রী নওফেল চৌধুরী যথার্থই বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছেন৷ এখন বিষয়টি আমাদের সবার অনুধাবনের সময় হয়েছে৷ খামাখা এসব কমিটি রেখে লাভ নেই৷ তাই কমিটি ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় ক্ষুদ্র পরিসরের একেকটি তদারকি কমিটি গঠন করে দিলে শিক্ষায় বৈপ্লবিক অগ্রগতি সাধিত হবে৷ তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই৷

লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক৷

স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.02773904800415