সারা দেশে আজ এইচএসসি, আলিম, কারিগরি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ১৩ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে। নকলমুক্ত এবং উৎসবমুখর পরিবেশে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে- এটাই সবার প্রত্যাশা।
এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ছাত্রছাত্রীরা উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করে। এ পরীক্ষার রেজাল্ট ক্যারিয়ার গঠনে দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করে থাকে। কাগজে-কলমে এইচএসসি দু’বছর মেয়াদি কোর্স হলেও বাস্তবে শিক্ষার্থীরা দেড় বছর সময়ও পায় না, উপরন্তু এ কোর্সের কলেবরও অনেক বিস্তৃত।
ফলে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া একটু বেশিই করতে হয়। পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের অভিভাবকদেরও চিন্তার অন্ত থাকে না। কিন্তু পরীক্ষার তত্ত্বীয় অংশ শেষ হলেই অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা মনে করে পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। প্র্যাকটিক্যালে তো এমনিতেই পূর্ণনম্বর চলে আসবে; ফলে অনেক ক্ষেত্রে এটাকে পরীক্ষার্থীরা ধর্তব্যের মধ্যেও আনে না।
১. ব্যবহারিক জ্ঞান একজন শিক্ষার্থীকে সংশ্লিষ্ট সাবজেক্টগুলো ভালোভাবে বুঝতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। তাই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নবম শ্রেণী থেকে রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, বায়োলজি ও অন্যান্য কয়েকটি সাবজেক্টে ১০০ নম্বরের মধ্যে প্র্যাকটিক্যাল বা ব্যবহারিক অংশের জন্য ২৫ নম্বর বরাদ্দ থাকে। সম্প্রতি আরও কয়েকটি সাবজেক্ট যেমন উচ্চতর গণিত, আইসিটি, ‘ক্যারিয়ার শিক্ষা’য় প্র্যাকটিক্যাল যুক্ত হয়েছে। এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষার আগে প্র্যাকটিক্যাল খাতায় সব আইটেম লিখতে ও ছবি আঁকতে হয়। প্রতিটি আইটেমে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের স্বাক্ষর নিয়ে ফাইনাল পরীক্ষার দিন জমা দিতে হয়। এই পদ্ধতি আগেও ছিল এবং আমাদের সন্তানদেরও একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে দেখছি। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের মূল উদ্দেশ্য- শিক্ষার্থীরা তত্ত্বীয় ক্লাসে যে বিষয়গুলো পড়ছে, সেগুলো আরও নিবিড়ভাবে বোঝা, হৃদয়ঙ্গম করা ও হাতে-কলমে শেখা। বিভিন্ন সাবজেক্টের প্র্যাকটিক্যাল অংশ একজন শিক্ষার্থী বা পরীক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কথা হল, প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস ও পরীক্ষাগুলো শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শিখতে ও মূল্যায়নে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারছে?
প্র্যাকটিক্যাল খাতায় লেখা ও ছবি আঁকার কাজগুলো অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই নিজে করে না। আশির দশকে চট্টগ্রাম কলেজে এইচএসসি পড়ার সময় বাইরের লোক দিয়ে ‘খাতা লেখা’ কমপ্লিট করে নিতে বন্ধুদের দেখেছি। সব ধরনের ছবি আঁকা ও লেখা কমপ্লিট করতে খাতাপ্রতি প্রায় ১০০ টাকা গুনতে হতো। এখনও ওই পদ্ধতি বহাল আছে; শুধু টাকার অঙ্কটা বেড়েছে। প্র্যাকটিক্যাল খাতা লেখা ও ছবি আঁকার কাজগুলো শিক্ষার্থীরা নিজে করে কিনা, তা কখনোই খতিয়ে দেখা হয় না বা দেখার প্রয়োজনবোধও করা হয় না। রসায়নের সল্ট অ্যানালাইসিস, জীববিজ্ঞানে তেলাপোকা, ব্যাঙের পরিপাক প্রণালি ও গাছের কোষ ব্যবচ্ছেদ প্রদর্শন, পদার্থবিদ্যায় স্লাইড ক্যালিপার্স দিয়ে ক্ষুদ্র কোনো কিছুর দৈর্ঘ্য নির্ণয়ে পরীক্ষা হলের ‘মামা’রাই পরীক্ষার্থীদের মুশকিল আসানে দেবদূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। অন্যকে দিয়ে লেখানো খাতায় ফাইনাল পরীক্ষায় প্রায় সবাই পূর্ণ নম্বর পেয়ে যাচ্ছে। ফলে ওই সাবজেক্টগুলোয় লেটার মার্ক চলে আসছে। মনে হচ্ছে, হয়তো এ সাবজেক্টগুলোয় বেশি নম্বর তোলার জন্যই ব্যবহারিক অংশ সংযোজিত হয়েছে। মা-বাবা গোল্ডেন জিপিএ প্রাপ্ত সন্তানের কৃতিত্বে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের মিষ্টিমুখ করাচ্ছেন। গর্বিত পিতা-মাতার ছবি ফেসবুকে আপলোড হচ্ছে, চারদিকে খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কখনও কি তলিয়ে দেখেছি- ওইসব বিষয়ে শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক জ্ঞান কতটুকু এগিয়েছে? একইভাবে মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য তৃতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত কিছু কিছু স্কুলে সেলাই শেখানোর ব্যবস্থা আছে। যেখানে টাক, রান, হেম, চেইন ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের সেলাই, কাপড়ের ওপর ডিজাইন ও উলের কাজ শেখানো হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ সেলাইগুলো ছাত্রীরা নিজে করে না; মা-খালা এবং অনেক ক্ষেত্রে বাইরে থেকে পয়সা দিয়ে করিয়ে স্কুলে জমা দেয়।
প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসগুলো সাধারণত দিনের সেশনের শেষদিকে রাখা হয়। তাই বাসায় ফেরার জন্য মন যখন উচাটন, শিক্ষার্থীরা তখন ভালোভাবে মনঃসংযোগ করতে পারে না। অনেক সময় ক্লাস থেকে আগেই বের হয়ে আসে। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস, পরীক্ষা, খাতা তৈরি ও সূচিকর্মের এ প্রক্রিয়া দীর্ঘকাল থেকে সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একইভাবে চলে আসছে। এ প্র্যাকটিক্যালকে কখনোই সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষের তরফ থেকেই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়নি। এটিকে বাড়তি সংযোজন হিসেবেই মনে করা হচ্ছে। তারপরও এটি দীর্ঘকাল থেকে সর্বজন গ্রহণযোগ্য ও স্বীকৃত পদ্ধতি হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে।
অধিকাংশ স্কুলে পর্যাপ্ত কম্পিউটার ও প্রশিক্ষক নেই। ফলে মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, এক্সএল, ই-মেইল অ্যাড্রেস খোলার পদ্ধতি, ফাইল-ফোল্ডার অ্যাটাচ করা ও অন্যের কাছে মেইলটি পাঠানোর পদ্ধতি শেখানোর বদলে মেইলের ভাষা কেমন হবে, তা মুখস্থ করানো হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রশিক্ষক ও কম্পিউটারের সংখ্যা এরূপ হওয়া দরকার যেন সব শিক্ষার্থী কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম ভালোভাবে আয়ত্তে আনার সুযোগ পায়। ইন্টারনেট প্রযুক্তির যুগে পরবর্তী প্রজন্মকে যদি স্কুল পর্যায়ে এ বিষয়গুলো যথাযথভাবে শেখাতে পারা না যায়, তাহলে বিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক কর্মজজ্ঞে ওরা কীভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত করবে?
ভূগোল পড়ানোর সময় কয়টি স্কুল-কলেজের ক্লাসে বাংলাদেশ ও বিশ্বের মানচিত্রটি দেয়ালে টাঙানো হয়? বিষুবরেখা, কর্কটক্রান্তি, মকরক্রান্তির অবস্থান, নদীর গতিপথ, কোথায় কোন নদী অপর নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে কী নাম ধারণ করেছে- এ বিষয়গুলো মানচিত্র সামনে রেখে পড়লে তোতাপাখির মতো মুখস্থ করতে হয় না। মনের মধ্যে সহজেই গেঁথে যায়।
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের ‘শিক্ষা সফর’ অন্যতম একটি অনুষঙ্গ। পাঠ্যসূচি মোতাবেক আহরিত তত্ত্বীয় জ্ঞানের বাস্তব প্রয়োগ দেখানোর জন্য সাধারণত ওইসব সফরের আয়োজন করা হয়। এতে ওরা যা দেখল, বুঝল, শিখল ইত্যাদির ওপর কখনও এককভাবে, কখনও আবার গ্রুপ ভিত্তিতে সার্বিক মতামত, পর্যবেক্ষণসহ প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। এ ধরনের পেপার তৈরি ও উপস্থাপনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজের পর্যবেক্ষণ ও মতামত থাকে না। পূর্ববর্তী ব্যাচের শিক্ষার্থীদের তৈরি রিপোর্টকে একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে প্রস্তুত করা হয়। ফলে যে উদ্দেশ্যে এ ধরনের কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত হয়, তা অনেক ক্ষেত্রে অধরাই থেকে যায়। অপূর্ণ ও ঝাপসা ধারণা নিয়ে উচ্চশিক্ষায়ও যথোপযুক্ত অর্জন আসছে না। উদ্ভাবনী কার্যক্রমে প্রতিবেশী প্রায় প্রত্যেকটি দেশই আমাদের ওপরে স্থান করে নিয়েছে। আমরা এখনও অর্থ ও সময়সাশ্রয়ী এবং দেশ, জনগণ, পরিবেশ ও মূল্যবোধকে প্রাধান্য দেয়ার প্রযুক্তির চর্চা, উদ্ভাবন ও বিকাশ ঘটাতে পারিনি।
২. বিদেশের স্কুল পর্যায়ে পাঠ্যসূচিতে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলা, বিরূপ পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাওয়াতে বাস্তব জ্ঞান অর্জনে বিভিন্ন ধরনের প্রজেক্ট অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশেও এ বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। জনগণ প্রতিনিয়ত যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে, পাঠ্যসূচির ব্যবহারিক অংশে সেগুলো সমাধানের উপায় সংযোজিত হতে পারে। সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের নিত্যসঙ্গী। এটি শুধু যে চালকের অদক্ষতা ও যানবাহনের ত্রুটির কারণেই সংঘটিত হচ্ছে তা নয়, আরও বহুবিধ কারণেই ঘটে থাকে। তাই ছোটবেলা থেকেই শিশুকে রাস্তায় চলাচল ও পারাপার, ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে চলার পদ্ধতি রাস্তায় নিয়ে সরেজমিন শেখানোর বিষয়টি প্রাথমিক ও জুনিয়র স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
ইদানীং বজ্রপাতে মৃত্যুর হার ব্যাপকভাবে বেড়ে চলেছে। গ্রাম-শহর সব জায়গাতেই বজ্রপাতে মৃত্যুর খবর মিডিয়ায় আসছে। বৃষ্টির দিনে বৈরী আবহাওয়ায় একটু সতর্কতা অবলম্বন করলে বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে সারা দেশে ব্যাপক হারে মানুষ মারা যাচ্ছে। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির নিরাপদ ব্যবহারের বিষয়ে সচেতন করা যেতে পারে।
অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে আমাদের শহরগুলো ইটপাথরের বস্তিতে পরিণত হয়েছে। শহরের ঘিঞ্জি এলাকাগুলোয় গা ঘেঁষে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। বিপদ মোকাবেলায় অ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি চলাচলের উপায় নেই। কোনো বড় স্ট্রাকচার ক্র্যাকডাউনে দ্রুত উদ্ধারের সক্ষমতাও সন্তোষজনক পর্যায়ে নেই। সাভারের বাইপাইলে ২০০৫ সালে ‘স্পেকট্রাম গার্মেন্ট’ ও ২০১২ সালে ‘রানা প্লাজা’ ধসের করুণ চিত্র এ কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। তাই স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যবইয়ের ব্যবহারিক অংশে ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড, হেভি স্ট্রাকচার ক্র্যাকডাউন ও বজ্রপাতে জানমাল রক্ষার পদ্ধতিগুলো অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
৩. প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসগুলোকে কার্যকর করার জন্য সংশ্লিষ্টদের আরও তৎপর হতে হবে। প্রয়োজনে প্র্যাকটিক্যাল অংশের কলেবর বৃদ্ধি এবং এর শিক্ষণ ও পরীক্ষা পদ্ধতিকে ঢেলে সাজাতে হবে। শিক্ষার্থীদের তত্ত্বীয় অংশের অস্বচ্ছতা দূর করার জন্য প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে প্রকৃতপক্ষেই হাতে-কলমে শেখার ব্যবস্থা করতে হবে; শিক্ষার্থীদের সরাসরি সম্পৃক্ত করতে হবে। তাই তো এ যুগের চোখ ধাঁধানো উন্নয়নের দেশ চীনে একটি প্রবাদ চালু আছে-
Tell me, I will forget
Show me, I may remember
Involve me, I will understand.
আমাদের স্কুলের একজন প্রধান শিক্ষক সবসময় বলতেন, ‘যে জীবনে গরু দেখেছে, সে গরুর ছবি আঁকতে পারবে।’ এখন অনুধাবন করতে পারি- এ কথার মধ্যে কত বড় দর্শন নিহিত রয়েছে। আমরা হয়তো ওইভাবে দেখেনি বলে আজও গরুর ছবি আঁকতে পারি না। তাই আমরা যেটা শিখছি, পড়ছি; সেটাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বুঝতে হবে। মনের মধ্যে স্বচ্ছ ধারণা তৈরি করতে হবে।
পরীক্ষায় শুধু বেশি নম্বর তোলার জন্য প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষাকে হাতিয়ার বানাতে দেয়া যাবে না। এটাকে প্রকৃত পক্ষেই অর্থবহ করতে হবে। কোনো বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা তৈরিতে ব্যবহারিক জ্ঞানের বিকল্প নেই। যথোপযুক্ত ব্যবহারিক জ্ঞানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের চিন্তার ক্ষেত্র ও উদ্ভাবনী ধারণার বিস্তৃতি ঘটানো সম্ভব। আর বিস্তৃত চিন্তাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরাই তো দেশ উন্নয়নের শ্রেষ্ঠ কারিগর।
লেখক: সরকারি চাকরিজীবী
সূত্র: যুগান্তর