ছাত্রজীবন সুখের জীবন, যদি না হতো পরীক্ষা। কথাটি শোনে নাই এমন অভিভাবক ও ছাত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ যুগের শিক্ষাব্যবস্থা বেশ আধুনিক। শিক্ষার্থীরাও জ্ঞান ও বিজ্ঞানে বেশ এগিয়ে। তবে কোনো কোনো শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের কার্যক্রম, শিক্ষকের মান ও শিক্ষার্থীদের আচার-আচরণ মাঝেমধ্যে বেশ মননশীল মনে হয় না। পরিচালনা পর্ষদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি কীভাবে পরিচালিত হবে তার দিকনির্দেশনা দেবেন, শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকের ও নীতিগত শিক্ষা প্রদান করবেন এবং সর্বোপরি শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুনের মধ্যে থেকে শিক্ষকদের মান্য করে যথাযথ শিক্ষা গ্রহণ করবেন, এটাই সকলের কাম্য। সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, শিক্ষার এই সুশৃঙ্খল প্রবাহ, তার কোনো একটির ব্যত্যয় হলেই দেখা দেয় হাজারো বিপত্তি আর এই বিপত্তির কারণে কখনো কখনো নিভে যায় অনেক প্রতিভাবান প্রাণ। পরিবারে নেমে আসে দুঃখের আর শোকের ছায়া। এ দুঃখ কষ্ট বুঝবার, জানবার আর শোধরাবার মতো নয়। বিষয়টি একটু ভেবে দেখা দরকার।
আজকাল একশ্রেণির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে নজর দিলে মনে হয়, তারা প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, আইনস্টাইন অথবা স্টিফেন হকিংস বানাবার দায়িত্ব নিয়া নিয়েছেন। শিক্ষা একটি সমন্বিত প্রয়াস। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। তাই এককভাবে ভালো ছাত্র বানাতে চাইলে তা যেমন হবার নয়, তেমনি এমন ভূতুড়ে অদ্ভুত কাণ্ড করে বসলে তাতে শিক্ষার্থীদের মনে শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি অত্যধিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। কোনো কোনো আবেগপ্রবণ শিক্ষার্থীর অকালে প্রাণও চলে যেতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের ছবি সংবলিত বোর্ডের কী দরকার? অথচ বাস্তবে কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাই করে চলেছে। আসলে পুথিগত শিক্ষায় শিক্ষিত জাতি কখনোই ভালো কিছু দিতে পারেনি, পারবেও না। যারা পুথিগত শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রের সমন্বয় ঘটাতে পারে—নীতি-নৈতিকতা নিয়ে চলে তারাই মূলত সমাজে প্রতিষ্ঠা পায় এবং জাতিকে কিছু দিতে পারে। শুধুই পুথিগত বিদ্যা শিক্ষার্থীদের/মানুষের মনে অহংকারে জন্ম দেয়, খুব বেশি গড়ালে তা হতাশায়ও পরিণত হতে পারে। তাই বলে আমি এটা বোঝাতে চাইছি না যে লিখিত পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেয়ে ভালো ছাত্রছাত্রী হওয়া যাবে না বা ভালো ছাত্রছাত্রী হবার দরকার নেই। বিষয়টি সে রকমও নয়—তাহলে একটি প্রশ্ন এসে যায়, সব ভালো ছাত্রছাত্রী কি জীবনে সফলতা পেয়েছে? সবার উদ্দেশে আমি যেটা বলতে চাই তা হলো ভালো ছাত্রছাত্রী হতে না পারলেই যে কেউ ব্যর্থ হয়ে গেল, সেটা ভাবা ঠিক নয়। আসলে ভালো মানুষ না হতে পারলেই জীবন ব্যর্থ হয়। স্কুল থেকে বের করে দেওয়া বহু মনীষী মানবসভ্যতার জন্য বহু মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন, আজ আমরা তাদের নাম জানি। অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে তাদের স্মরণ করি।
কথা হলো শিক্ষার্থীদের বোর্ডে নাম ও ছবি থাকতে বাধা নেই, যদি সেটা কৃতী ছাত্রছাত্রীদের বোর্ড হয়। কৃতী ছাত্রছাত্রীদের বোর্ডে নাম ও ছবি দেখে অন্যরা ভালো ছাত্রছাত্রী হতে চাইবে, অনুপ্রেরণা পাবে—এটাই তো স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আর অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের বোর্ডটি কি খারাপ ছাত্রদের ভালো ছাত্রে পরিণত করতে পারবে? তাহলে এরকম প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রশ্ন, আপনারা কি ১০০ ভাগ নিশ্চিত এই বোর্ড ও তার ছবি উক্ত শিক্ষার্থীদের ভালো ছাত্র বানাবে? এই বোর্ড কি দুর্বল ছাত্রদের প্রতি ভালো ছাত্রদের ঘৃণার জন্ম দেবে না? এই বোর্ড কি ছাত্রছাত্রীদের মেলামেশায়, একত্রে হেসে-খেলে বড়ো হবার অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে না? আসলে শিক্ষা হলো সেই অমূল্য ধন, যা মানুষকে মানুষ হিসাবে ভাবতে শেখায়। জ্ঞান মানুষকে বিনয়ী করে, মানুষকে মহত্ করে, সাধারণ মার্জিত জীবন যাপন করতে শিক্ষা দেয়। আরেকটি প্রশ্ন করা যায়, এসব দুর্বল ছাত্রছাত্রী তবু স্কুলে এসেছে, আর যারা স্কুলে আসতে পারল না তাদের ছবি কি ওয়ার্ড কমিশনাররা ওয়ার্ডের বিশাল বিশাল দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখবেন? অথবা অফিসে-আদালতে গিয়ে কি আমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্বল কর্মকর্তাদের নাম ও ছবি দেখতে পাব? আসলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বোর্ডে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের নাম ও ছবি থাকা বাঞ্ছনীয় নয়, কাম্যও নয়। এখন যদি কোনো কোনো অভিভাবক প্রশ্ন করে বসেন যে দুর্বল শিক্ষকদের বোর্ড চাই, নাম চাই, ছবি চাই, দুর্নীতিবাজ শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ছবির বোর্ডও চাই—তাহলে ব্যাপারটি কেমন হবে তা একবার কি আমরা ভেবে দেখেছি?
আমরা যখন স্কুলে পড়তাম তখন ভালো শিক্ষকরা মেধাবী গরিব ছাত্রদের খুঁজে বের করে বিনা বেতনে তাদের পড়াতেন। এ যুগে এমন শিক্ষক কি পাওয়া যাবে? হয়তো-বা আছেন, তবে তার সংখ্যা নেহাতই কম। আসলে নীতি-নৈতিকতার বাইরে গিয়ে যদি কোনো কিছুকে শিক্ষা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তা শিক্ষা নয়। এমন শিক্ষা জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। আমরা সে শিক্ষায় শিক্ষিত জাতি দেখতে চাই যে শিক্ষার কারণে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে। কেউ যদি দাঁড়াতে না পারে অন্যজন তাকে দাঁড়াতে সাহায্য করবে। মানুষ সুশিক্ষিত জাতি দেখতে চায়; শিক্ষাকে পুঁজি করে দুষ্ট প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিকভাবে লাভবান প্রতিষ্ঠান দেখতে চায় না।
বর্তমান সরকার শিক্ষার উন্নতির জন্য নানাবিধ পদক্ষেপ নিয়েছে। বছরের শুরুতেই একটি দেশের সব ছাত্রছাত্রীর হাতে নতুন বই তুলে দেবার ঘটনা এদেশে বিরল ছিল। শিক্ষার বিষয়ে মেয়েদের ও অনাগ্রসর জনপদের বাসিন্দাদের জন্য সরকার বহু সুযোগ-সুবিধাও করে দিয়েছেন। সরকার নিত্য নতুন পদক্ষেপের মাধ্যমে শিক্ষাকে যুগোপযোগী করছে। শিক্ষাক্ষেত্রে নানা রকম প্রযুক্তির ব্যবহারও নিশ্চিত করেছে, যা ছাত্রছাত্রীদের জন্য খুবই কল্যাণকর। এ সময় সবার দরকার সরকারের সঙ্গে থেকে শিক্ষাকে দুর্নীতিমুক্ত করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। শিক্ষাকে সবাই মিলে আরো বেগবান করা।
পরিশেষে একটি বিশেষ ঘটনা দিয়ে শেষ করতে চাই। একবার এক ব্যক্তির ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে এক কর্মচারীর হাত টানের অভ্যাস হয়ে গেলে পরামর্শ নিতে উক্ত ব্যবসায়ী একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে গেলেন। প্রতিষ্ঠানটি তাকে সিসি ক্যামেরা লাগাতে বলল। উক্ত ব্যবসায়ীর রান্নাঘরের খাবার কাজের লোকেরা লুকিয়ে খেতে শুরু করল। সেই ব্যবসায়ী আবার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে গেলেন, উক্ত প্রতিষ্ঠান রান্নাঘরে সিসি ক্যামেরা লাগাতে বলল। এরপর ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ায় ফাঁকি দিতে শুরু করলে উক্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানটি ঘরের বেডরুমে সিসি ক্যামেরা লাগাতে বলল। এতে করে সবাই ভয় পেল, সাময়িক চুরি ও খাবার খাওয়া বন্ধ হলো এবং ছেলেমেয়েদের মধ্যে লেখাপড়া করার ভান জন্ম নিল আর সেই ব্যবসায়ীকে মাসে মাসে উক্ত প্রতিষ্ঠানকে টাকা দিতে হলো। মাসিক খরচ বেড়েই চলল—ভালোবাসা এলো না, নৈতিক শিক্ষা এলো না, বিশ্বাস এলো না, উপদেশ এলো না, শুধুই মেশিন আরো মেশিন। যন্ত্র দিয়ে নৈতিক শিক্ষা লাভ করা যায় না।
লেখক : লে. কর্নেল মো. সাইফুল ইসলাম, এ এইচ কিউ, কিউ এম জি এস ব্রাঞ্চ।