মানবসভ্যতার ইতিহাস বলছে, অতি উৎসাহী স্তাবকতা কারোর জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না। স্তাবকরা ব্যক্তিগত উন্নয়নের জন্য নিয়ন্ত্রণকর্তার বিবেক শূন্য করে ফেলে। ফলে পরিণতি শুভ হয় না। তবু এক স্তাবক বিদায় হলে অন্য স্তাবক গজিয়ে ওঠে। এমনইভাবে ভাঙাগড়ার ভেতর দিয়ে সভ্যতার গতি মাঝেমধ্যে মন্থর হয়। ইতিহাসের এই অভ্রান্ত কথন কেউ পড়ে দেখে না। বিবেচনা করে না হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘তৈল’ প্রবন্ধ কিংবা মুহম্মদ আব্দুল হাইয়ের তোষামোদ ও রাজনীতির ভাষার সতর্কবাণী। স্তাবকদের থেকে শেকসপিয়ার সাবধান থাকতে বলেছেন। তাঁর ভাষ্য, ‘এভরিওয়ান দ্যাট ফ্লাটার্স ইজ নো ফ্রেন্ড ইনমিজেরি।’ কবি হালি মুখের সামনে তোষামোদকারীর মুখে ছাই ছিটিয়ে দিতে বলেছেন। আর বিদ্যাসাগর আড়ালে বদনামকারীদের চিহ্নিত করেছেন এভাবে যে তারা কোনো কোনোভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত স্তাবক এবং তাদের বেশির ভাগই অকৃতজ্ঞ।
আমি অর্ধশতাব্দীকালেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দেখে আসছি শিক্ষা নিয়ে জুয়া খেলার পালা। একসময় বাংলাদেশের কৃষিকে প্রকৃতির জুয়া খেলা বলা হতো। এখন বাংলাদেশের শিক্ষা নিয়ে জুয়া খেলা চলছে। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন যাঁরা হাতে-কলমে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট নন; কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারকারী স্তাবক। গত শতকের আটের দশকে নকল রোধের জন্য উত্তর-প্রশ্ন সংক্ষিপ্ত ও রচনামূলক করার ব্যবস্থা নেওয়া হলো। করা হলো চকিতে উত্তর লেখার এমসিকিউ পদ্ধতি। এর জন্য আবার প্রশ্ন ব্যাংকও তৈরি হলো। প্রশ্নপত্র প্রণয়নের স্বাধীনতা খর্ব হলো। এখানেই শেষ নয়, এখন আমদানি করা হয়েছে সৃজনশীলতা। নতুন কিছু সৃষ্টির অপর নাম সৃজন। যথেষ্ট মেধা আর দক্ষতা ছাড়া সৃজক হওয়া যায় না। অথচ অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষাজীবীদের ওপর এই ভার দেওয়া হলো। বিষয়টির তাৎপর্য না বুঝে তা সর্বত্র চালু করার ফরমান জারি করা হলো। আমদানিকারক ভাবলেন, নতুন কিছু করলেন। কর্তৃপক্ষকে স্তাবকতায় বোঝালেন এ এক অভ্রান্ত শিক্ষাব্যবস্থা। ভেবে দেখা হলো না, কারা পড়াবেন বা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করবেন। অর্থের অপচয় ঘটিয়ে ট্রেনিং দিয়েও দেখা গেল, তেমন উন্নতি হয়নি। সর্বত্রই গাইডের প্রাধান্য। এখন শুনছি ‘স্টুডেন্ট ইউনিট লার্নিং’ নামের এক উদ্ভট শিক্ষাদান প্রক্রিয়া শুরু করার পাঁয়তারায় নেমেছেন এক শ্রেণির স্তাবক।
অতীতের সব কিছু অভ্রান্ত ছিল কিংবা ভ্রান্ত, সে মন্তব্য করা থেকে আমরা বিরত থাকতে চাই। দীর্ঘ সময়ের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, আমাদের সব অর্জন মেকি ছিল না। যাঁরা আজ নতুন নতুন প্রেসক্রিপশন উপস্থাপন করছেন তাঁরা প্রায় সবাই সাবেকি পদ্ধতির লেখাপড়া করা উচ্চপদস্থ ব্যক্তি। তাঁদের সন্তানরা পাখা মেলে উন্নত দেশে। বেচারা গরিব আমাদের সন্তানরা নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর মাধ্যমিকের আগে একাধিক পরীক্ষার ফাঁদে খেই হারিয়ে ফেলছে। এর ফলে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে কিছুটা উন্নতি করলেও ভাষাজ্ঞান সীমিত হয়ে আসছে। তাই বর্তমান প্রজন্ম সাহিত্য-সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এর ফলে ডিগ্রিপ্রাপ্তরা মানবিক গুণাবলি ছেড়ে চোরাবালিতে বিভ্রান্ত হচ্ছে।
আমাদের দেশে কোথায় কতজন পারদর্শী জনশক্তি দরকার, তা খতিয়ে দেখা হয় না। যত্রতত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয়। প্রকৃত শিক্ষাবিহীন এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসা শিক্ষার্থীরা পতঙ্গের ঝাঁকের মতো নানা বাহারি পাবলিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সনদ কেনার জন্য উদ্বাহু হয়। প্রতিষ্ঠানে নতুন কিছু করার অন্তঃসারশূন্য ‘অভিপ্রায়ে’ এমন কিছু বিভাগ প্রবর্তন করা হয়, যাতে চমক আছে এবং গালভরা ডিগ্রি অর্জনও ঘটে; কিন্তু কর্মসংস্থান হয় ভগ্যবানদের। কে জানে, এসবের পরিণতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত, রাষ্ট্র পরিচালনায় কতজন কাম্য জনশক্তির প্রয়োজন। কীসংখ্যক শিক্ষাপ্রত্যাশীকে সাধারণ শিক্ষা অর্জনে সুবিধা দিলে চলবে। প্রযুক্তি-প্রকৌশলের উচ্চশিক্ষায় এবং কৃষি ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে কতসংখ্যক বিশেষজ্ঞের দরকার, সেটা ঠিক করে নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিধি নির্ধারণ করা হলে আমাদের প্রকৃত শিক্ষিতরা বেকার থাকত না। যেনতেন প্রকারে ডিগ্রি প্রাপ্তির প্রতিষ্ঠান খোলার সুযোগ পেয়ে, শিক্ষা ব্যবসায়ী ও স্তাবকদের বিদেশি প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী শিক্ষার ব্যবস্থা করে অর্থ-মেধা উভয়েরই অপচয় হচ্ছে।
শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন নিয়ে নতুন করে ভাবনা শুরু হয়েছে। বিএড ডিগ্রির প্রতি গুরুত্বের কথা শুনছি। মনে রাখা দরকার, প্রশিক্ষণ জ্ঞাত বিষয়কে পরিমার্জন করার কৌশল শেখায়। মেধার বিকাশ ঘটায় না। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য সফল করতে হলে মেধাবী শিক্ষক অপরিহার্য। আর মেধার বিষয়টি বিধিদত্ত, সহজাত। তাঁদের খুঁজে বের করতে পারলে আমাদের কাম্য শিক্ষা স্তাবকদের কবল থেকে মুক্ত হবে।
লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ