স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর বাংলাদেশের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, অর্জন-বিসর্জনের হিসাব মেলানো ভার। সবকিছু বাদ দিয়ে যদি শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কথা বলি সেটাও মহাকাব্যের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তারপরও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়- এ দেশে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থেকে খারাপকে খারাপ, অন্যায়কে অন্যায় বলার সাহস দেখানোর মতো মানুষ হাতের আঙুলে গুনে ফেলা যায়। সেই জনাকয়েক প্রাণের মধ্যে আহমদ ছফার মতো একজন ব্যক্তিকে পাওয়া সৌভাগ্যের চেয়েও বেশি কিছু।
তিনি বিখ্যাত পরিবারের কেউ ছিলেন না। সুবক্তাও ছিলেন না। অধ্যাপক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী বা রাজনৈতিক নেতা- কোনো কলেবরেই তাকে ঠিক জুতসইভাবে বাঁধা যায় না। মূলত স্বভাবসুলভ বর্ণনায় অপ্রিয় সত্যের লেখালেখি তাকে সফলতা এনে দিয়েছিল। সফলতা বলতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নয়, সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। ছফা বলতেন, ‘সফলতা একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। জাতির মর্মমূল স্পর্শ করে যদি ব্যর্থও হই, তার একটা আলাদা মূল্য আছে। মামুলি সার্থকতার চাইতে মহৎ ব্যর্থতার মূল্য অনেক বেশি।’ নির্মোহ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সুস্পষ্ট ও যৌক্তিক বিরোধিতায় আহমদ ছফা যে মুনশিয়ানা দেখিয়েছিলেন তাতে তার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছিল প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে। অন্যায় বা যে কোনো অপতৎপরতার বিরুদ্ধে তিনি শুধু কলম ধরেই ক্ষান্ত হননি, সশরীরে রাস্তায় নেমেছেন, নিজে প্রতিবাদ করেছেন, অন্যদেরও সংগঠিত করেছেন। যখন এদেশের সাহিত্য চর্চার চরম দুর্দিন, প্রথম সারির কবি-লেখকরা রাষ্ট্রশক্তির তাঁবেদারিতে মত্ত, সেই চরম দুঃসময়ে ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’-এর মতো একটি প্লাটফর্ম তিনি একরকম একহাতে দাঁড় করিয়েছিলেন।
এদেশের লেখকদের ওপর, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ওপর যতবার আঘাত এসেছে, আহমদ ছফা স্পষ্টভাবে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদের পরিবারকে ঘরছাড়া করার এবং তসলিমা নাসরিনের ওপর আক্রমণের তিনিই প্রথম প্রতিবাদ করেন। হুমায়ূন আহমেদের পরিবারকে ঘরছাড়া করার ঘটনায় তিনি তো রীতিমতো গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মাহুতি দিতে উদ্যত হয়েছিলেন। নামকরা চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন আহমদ ছফা। তার শিল্পকর্মকে বিশ্বদরবারে নিয়ে যাওয়ার জন্য ছফার চেষ্টার অন্ত ছিল না।
মূলত লেখালেখিকেই নিজের প্রকাশমাধ্যম হিসেবে নিলেও ছফা রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন গভীরভাবে। রাজনীতিকে খুব বড় স্থান দিতেন তিনি। এদেশের প্রগতিশীল ধারার রাজনীতিতে ছফার আগ্রহ ছিল। মূলত তিনি এই ধারার রাজনীতির সঙ্গেই নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশের প্রগতিশীল ধারার রাজনীতির বারবার ব্যর্থতার কারণও ছফা স্পষ্ট করেছিলেন। ছফা বলেছিলেন, ‘যারা মৌলবাদী তারা শতকরা একশ’ ভাগ মৌলবাদী। কিন্তু যারা প্রগতিশীল বলে দাবি করে থাকেন তাদের কেউ কেউ দশ ভাগ প্রগতিশীল, পঞ্চাশ ভাগ সুবিধাবাদী, পনেরো ভাগ কাপুরুষ, পাঁচ ভাগ একেবারে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন।’
১৯৪৩ সালের ৩০ জুন জন্ম নেয়া আহমদ ছফার মৃত্যু হয় ২০০১ সালের ২৮ জুলাই। সেই হিসাবে আজ ১৭ বছর হতে চলল আহমদ ছফা আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু ছফা তার দর্শন, স্পষ্ট অবস্থান ও লড়াইয়ের জন্য এখনও জারি আছেন। আমাদের সামনের দিনের পথপরিক্রমায় ছফা যে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন তা নির্দ্বিধায় বলা চলে।
লেখক: শিক্ষানবিস আইনজীবী
সূত্র:যুগান্তর