স্বতন্ত্র আইন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা - Dainikshiksha

স্বতন্ত্র আইন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু |

সুশৃঙ্খলভাবে সমাজে বসবাসের জন্য এবং দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্য আইনের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। মানবসভ্যতার শুরু থেকেই আইনের প্রয়োজনীয়তা ছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তাইতো মানবজীবনে আইন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলা হয়, ‘Ignorance of law is no excuses.’ অর্থাৎ আইন না জানা কোনো অজুহাত হতে পারে না। আবার আইন না জানার কারণে কৃত অপরাধ থেকে মাফও পাওয়া যায় না এবং এ জন্য কাউকে ক্ষমা করা যায় না। সুতরাং দেশের নাগরিক হিসেবে সংশ্লিষ্ট দেশের আইন-কানুন সম্পর্কে জানা প্রত্যেকেরই দায়িত্ব এবং কর্তব্য।

আইনের পরিধি অনেক বিস্মৃত হওয়ায় আইন নামক বিষয়টিকে নির্ধারিত কোনো সীমা বা গণ্ডির মধ্যে ফেলা যায় না। এ কারণে আইন বিষয়কে অনেকে ‘এভার গ্র্রিন’ বিষয় হিসেবেও আখ্যায়িত করে। আর আইনের ব্যাপ্তি সম্পর্কে প্রবাদ আকারে বলা হয়, ‘আকাশে যত তারা আইনের তত ধারা।’ অর্থাৎ আকাশের তারা যেমন গণনা করে শেষ করা যায় না, ঠিক তেমনি আইনের ধারাও গণনা করে শেষ করা যায় না। বাংলাদেশে ১৯৯২ সালে সর্বপ্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়নের আগে শুধু কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পাঠদান করানো হতো। কিন্তু ১৯৯২ সালে প্রথমবারের মতো দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়ন করার ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও চার বছর মেয়াদি সম্মান ও এক বছর মেয়াদি এলএলএম প্রগ্রামে আইন বিষয়ে পাঠদান করানো হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন (প্রথমে ১৯৯২ সালে এবং সর্বশেষ ২০১০ সালে) পাস হওয়ার পর দেশে আইন শিক্ষার দ্বার অনেকটাই উন্মোচিত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়; যদিও বেসরকারি বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন শিক্ষার মান নিয়ে শুরু থেকেই যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পাঠদানের ফলে অনেক শিক্ষার্থী আইন বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে নিজেদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ করে চলেছে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্নকারীরা পরবর্তী সময় ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি (এমফিল/পিএইচডি) অর্জন করার সুযোগ পেলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুধু স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করা ছাড়া উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করার সুযোগ পায় না। কারণ যৌক্তিক বিবেচনায় এবং শিক্ষার মানদণ্ডের নিরিখে এখন পর্যন্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল বা পিএইচডি করার কোনো বিধান রাখা হয়নি। যা হোক, আইনের একজন শিক্ষার্থী স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করার পর সে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের  (জেএসসি) তত্ত্বাবধানে পরিচালিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সহকারী জজ হওয়ার সুযোগ পায়। এতে অন্য কোনো বিষয়ের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করতে পারে না, যা আইনের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বিশেষ সুযোগই বটে। অন্যদিকে অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষার্থীরা বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায় এবং এখানে আইন বিষয়ের শিক্ষার্থীরাও  অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। আবার আইনের শিক্ষার্থীরা আইন বিষয়ে ডিগ্রি নেওয়ার পর আইনজীবী হওয়া ছাড়াও ব্যারিস্টার হওয়ার সুযোগ পায়, যা অন্য বিষয়ের শিক্ষার্থীরা পায় না। তা ছাড়া আইনে ডিগ্রিধারী একজন শিক্ষার্থী ব্যাংক, বীমা, সরকারি-বেসকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, রিসার্চ ফার্মসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার ও আইন বিষয়ক সংস্থা বা সংগঠনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও সহজেই বিভিন্ন পদে কাজ করার সুযোগ পায়। এদিক থেকে বলা যায়, আইন বিষয়ের ক্ষেত্র অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি।

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশে বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় থাকার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক আইন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় (যেমন—কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তা ছাড়া দেশে একাধিক মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আইন বিষয়ের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় দেশে এখন পর্যন্ত স্বতন্ত্রভাবে কোনো আইন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠেনি। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার সামগ্রিক কার্যক্রমকে অধিকতর গতিশীল করতে এবং দেশে আইনের শাসন আরো সুদৃঢ় করতে অধিকসংখ্যক দক্ষ বিচারক ও দক্ষ আইনজীবী দরকার। দেশে যত বেশি উচ্চশিক্ষিত, দক্ষ ও উত্কৃষ্ট মানের বিচারক ও আইনবিদ থাকবেন তত দ্রুতই সম্ভব হবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। আইন বিষয়ে সচেতন প্রত্যেকেই এ কথা জানেন যে আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশে আইনব্যবস্থা মূলত ‘কমন ল’ ভিত্তিক। এখানে আনীত অপরাধীকে এ ব্যবস্থায় নিরপরাধ ভেবে আদালতে বিচার হয়। অভিযোগকারীকে আনীত অভিযোগ প্রমাণ করতে হয়। এতে দীর্ঘসূত্রতা আর ঝামেলার যেন অন্ত থাকে না। বিচারকের এ ক্ষেত্রে কোনো কিছু করার থাকে না।

অহেতুক আন্দোলন ও নানা অপরাধ-সম্পৃক্ত কার্যকলাপ ‘সিভিল ল’ ব্যবস্থায় যথাসময়ে প্রশমিত করা সম্ভব হয়। আর সৃষ্টিমুখী আইন শিক্ষা প্রবর্তনে গতিশীল আইন ব্যবস্থায় শান্তি-শৃঙ্খলার স্থায়িত্ব জাতিকে উজ্জীবিত করতে পারে। এদিক বিবেচনায়, আমাদের দেশে স্বতন্ত্রভাবে অন্তত একটি হলেও আইন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বর্তমানে আমাদের দেশের অসংখ্য শিক্ষার্থী আইন বিষয়ে পড়াশোনায় আগ্রহী। তুলনামূলক কম খরচে দেশে আইনে পড়াশোনা করে ছাত্র-ছাত্রীরা দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত হতে পারে। ফলে ভবিষ্যতে দক্ষ বিচারক ও আইনজীবী তৈরি করতে দেশে মানসম্পন্ন স্বতন্ত্র আইন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা এখন সময়ের দাবি। এর আগে এ বিষয়টি জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও হয়েছে, আবার সমাজের বিশিষ্টজনরা বিভিন্ন সভা-সেমিনার ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি জোর দাবিও জানিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ফল শূন্য। ভারতের নয়াদিল্লি, বিশাখাপত্তম, হায়দরাবাদ, পাটনা, রায়পুর, গান্ধীনগর, বেঙ্গালুরু, কোচিন, ভূপাল, পুনা, চণ্ডীগড়, মাদ্রাজ, কলকাতা ও অন্যান্য শহরে প্রায় ২৫ থেকে ৩০টি আইন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এগুলো মানসম্পন্ন আইন শিক্ষা জাতিকে উপহার দিয়ে আসছে। এসবের প্রাসঙ্গিকতায় বাংলাদেশের জন্য সৃষ্টিমুখী আইন শিক্ষা লাভের সুযোগ সৃষ্টি দেশের জন্য অপরিহার্য বিষয় হয়ে পড়েছে। বর্তমান সরকার এ দেশের নাগরিকদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে আইন ও আইন বিষয়ের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব উপলব্ধিপূর্বক দেশে অন্তত একটি হলেও আইন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার লক্ষ্যে দ্রুত এগিয়ে আসবে—এমনটাই সবার প্রত্যাশা।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033979415893555