স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা শিক্ষকরা কবে দেখতে পাবেন বাসন্তী পূর্ণিমার চাঁদ? - দৈনিকশিক্ষা

স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা শিক্ষকরা কবে দেখতে পাবেন বাসন্তী পূর্ণিমার চাঁদ?

এম আবু বককার মল্লিক |

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার মাধ্যমে দেশের মাদরাসা শিক্ষার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। আলিয়া মাদরাসার সার্বিক উন্নয়নসহ বহু মাদরাসা এমপিওভুক্ত করেছেন তিনি। কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের (তাকমীল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমর্যাদা দিয়েছেন তিনি। করোনার এই মহামারিরকালে কওমি মাদরাসাগুলোকে আর্থিক অনুদানও দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে 'কওমি জননী' উপাধিতে ভূষিত করা এক যুগান্তকারী ঘটনা।

আমরা জানি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার বিষয়ে অত্যন্ত সদয় এবং সহানুভূতিশীল। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা সংক্রান্ত নীতিমালা ২০১৮ প্রণয়ন ও অনুমোদনসহ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকদের বিভিন্ন সময়ে ভাতা বৃদ্ধি এবং যাবতীয় উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এ সরকারের মাধ্যমে পূরণ হতে চলেছে। জাতি এ কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণকরে। এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা,  শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, মাননীয় শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও মাদরাসাবিভাগের সচিব এবং সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তাসহ সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ইবতেদায়ি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা শুরু হয়। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে একই পরিপত্রে রেজিস্ট্রার প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষকদের বেতন ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে ২৬ হাজার ১৯৩ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও
সত্য যে, অভিন্ন আইনে প্রতিষ্ঠা হলেও বঞ্চিত থাকে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা। বর্তমান শুধুমাত্র ১ হাজার ৫১৯টি অনুদানপ্রাপ্ত স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রধান শিক্ষক ২ হাজার ৫০০ টাকা ও সহকারী শিক্ষক ২ হাজার ৩০০ টাকা তিন মাস পর পর ভাতা পান। নামমাত্র পাওয়া এই বেতন ভাতা দিয়ে একটি পরিবারের ভরণপোষণ কোনভাবেই সম্ভব নয়।

২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের নীতিমালা জারির আগে, কয়েক দশক ধরে ইবতেদায়ি মাদরাসার উন্নয়নে কোন চলমান প্রক্রিয়া না থাকায় অনুদানপ্রাপ্ত অনেক শিক্ষকের মৃত্যু বা চাকুরী থেকে অবসরের পরেও বছরের পর বছর ধরে তাদের ভাতা আসছে। এমন কি এক থেকে দুই যুগ সময় পার হলেও তাদের নামে ব্যাংকে ভাতা আসে আবার ফিরে যায়। অনেক প্রতিষ্ঠানে সাবেক সব শিক্ষকের ভাতা ব্যাংক থেকে ফেরত যায়। অথচ এ সব স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসায় অনেক শিক্ষক শূন্য পদে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত থেকেও কোন বেতন ভাতা পান না।

সুদীর্ঘ প্রায় ৩৫ বছর অপেক্ষার পর, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা সংক্রান্ত নীতিমালা ২০১৮ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩১১ কোটি টাকা বরাদ্দে চার হাজারের অধিক স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা এমপিওভুক্তির বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এ পর্যন্ত এর কোন বাস্তব প্রতিফলন না ঘটায়, ইবতেদায়ি শিক্ষকদের ভগ্ন হৃদয়ে হতাশার কালো মেঘ জমাট বেঁধেছে। যেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার তেত্রিশ বছর পার করেও ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রতীক্ষার প্রহর সামনে আরও এগিয়ে গেল। দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর, পেরিয়ে আসে যুগ, এরই মাঝে চলে গেল কত ঈদ, কত বাসন্তী পূর্ণিমা, কত আনন্দ কোলাহল। কিন্তু হতভাগা স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের জীবনে নেই কোন আনন্দ, আর এদের জীবনে আসে না কোন বসন্ত, জীবনের শেষ বেলায় চেয়ে আছে যেন অজানার পথপানে।

এই বাংলার প্রান্তরে প্রান্তরে কত যে শিক্ষক, বয়সের ভারে নত হয়ে সুদীর্ঘ কর্মজীবন শেষে শত দরিদ্রতার বোঝা কাঁধে নিয়ে ছিন্নবস্ত্রে মলিন মুখে বহু শ্রম আর সাধনায় গড়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার আঙ্গিনা ছেড়ে রিক্ত হস্তে বিদায় নিয়ে গেছেন, কে তার হিসাব রাখে? বের হয়ে যায় আর তারা যেন বারবার ডেকে ডেকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের '১৪০০ সাল' কবিতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

'আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি কৌতূহলভরে, এ ব্যথা আমরা রাখবো কোথায়?'

বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) জরিপে ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলায় মোট স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার সংখ্যা ছিল ৯টি। বর্তমান ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে ব্যানবেইস এর তালিকায় দেখা যাচ্ছে শালিখা উপজেলায় নিজ অস্তিত্ব নিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান। শালিখার 'নিত্যানন্দী স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা যেন কবি যোগীন্দ্রনাথের 'হারাধনের দশটি ছেলে' কবিতার সার্থক রূপ। 

বর্তমান সরকারের বহুমুখী উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়নে সারাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। অনুদানের স্রোতধারা শত দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার সার্বিক উন্নয়নকল্পে মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ থেকে গত ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এ পর্যন্ত কয়েক ধাপে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য নেয়া হয়েছে। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা সংক্রান্ত নীতিমালা ২০১৮ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারের এ কর্ম প্রক্রিয়ায় গৃহীত ব্যবস্থায় আমরা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি।

দীর্ঘ দিনের প্রত্যাশা, হয়তো বা কোন একদিন প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা সরকারিকরণের ঘোষণা দেওয়ার মাধ্যমে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার গগনে আঁধার রাতের কালো মেঘ কেটে বাসন্তী পূর্ণিমার চাঁদ উঁকি দিয়ে হেসে উঠবে আর কিরণ ছড়াবে সবুজে ঘেরা পল্লী গাঁয়ের বাঁকে বাঁকে থাকা শিক্ষকদের পরিবারের জীর্ণ কুটিরে। এ মহা আনন্দের সমারোহে ইবতেদায়ি মাদরাসার অঙ্গনে অঙ্গনে মুখরিত হবে ছোট্ট ছোট্ট ছেলে মেয়েদের লেখা-পড়া আর হাসি-খেলায়।

সেদিন ইবতেদায়ি মাদরাসার আকাশে বাতাসে বাজবে সুর। কবি নজরুলের কবিতা থেকে ধ্বনিত হইবে মহা উল্লাসে, মহা উৎসবে শিক্ষকরা বলবেন, 'ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়। তোরা সব জয়ধ্বনী কর! তোরা সব জয়ধ্বনী কর'।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা সংক্রান্ত নীতিমালা- ২০১৮ জারি হলে ইবতেদায়ি পরিবার তাদের ভাঙ্গা ঘরে যেন চাঁদের আলো দেখতে পেয়েছিলেন। কিন্তু পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের 'পল্লী জননী' কবিতার আঁধার কাল রাত শেষ করে কবে সে বাসন্তী পূর্ণিমার চাঁদ আসবে এ জীর্ণ কুটিরে? 

পল্লীকবি হয়তো স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের পরিবারের জন্যই 'আসমানী' কবিতা রচনা করেছিলেন! এই রকম শত শত আসমানীদের অনেক ছোট-খাটো চাওয়া-পাওয়া আছে, তাদের দাবিগুলো পূরণে আপনাদের সামান্য একটু সহানুভূতি আমাদের জন্য অনেক কিছু। আমরা আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছি, আপনাদের একটু সুদৃষ্টি বয়ে আনতে পারে অনাহারী, হতভাগা ও বঞ্চিত এই স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের পরিবারে অনাবিল আনন্দের স্রোতধারা।

ধর্মহীন কর্মশিক্ষা ও কর্মহীন ধর্ম শিক্ষা, এই দুয়ের মাঝে সমন্বয় রেখে আদর্শ জাতি ও সমাজ গঠনে প্রাথমিক ফাউন্ডার হিসাবে বাংলাদেশের স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা বিশ্বের বুকে চির অম্লান হয়ে জেগে ওঠার শুভ কামনায় শেষ করলাম। 

লেখক:  প্রধান শিক্ষক, নিত্যানন্দী স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা, শালিখা, মাগুরা।

[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন]

অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0055348873138428