এ বছরের ১ জানুয়ারি সকালে কলকাতায় ফেয়ারলি প্লেসে যাওয়ার জন্য বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে বাস এসে থামতেই উঠে পড়লাম; কিন্তু ১০ গজ যাওয়ার আগেই ট্রাফিক সার্জেন্ট হাতের ইশারায় বাস থামিয়ে কন্ডাক্টরের হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন। ঘটনাটা মুহূর্তের মধ্যে ঘটে যাওয়ায় কিছু বুঝতে পারিনি। কন্ডাক্টরের হাতে ভাড়া দেওয়ার পর সে দুটি টিকিট দিয়ে বলল, ‘দাদা, ভাড়া দিলেন ১৬ টাকা আর বছরের প্রথম দিন সকালে ২০০ টাকা ফাইন।’ কার্যকারণ জিজ্ঞেস করে জানলাম গোল পার্ক মোড়ের এই স্টপেজ কিছুটা পেছনে। রাস্তায় যানজট ছিল না, বাসস্ট্যান্ডে যাত্রীর ভিড় ছিল না, সামনে-পেছনে বাসের প্রতিযোগিতা ছিল না। শুধু স্ট্যান্ড থেকে ১৫ থেকে ২০ গজ সামনে এসে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দণ্ড। আমাদের অনেক বাসস্ট্যান্ডে আজকাল লিখে রাখা হয়েছে ‘দাঁড়ালেই দণ্ড’! বলা নিষ্প্রয়োজন, এসব সাইনবোর্ডের নিচেই দায়িত্বে দাঁড়িয়ে থাকা নির্বিকার পুলিশের সামনে প্রতি মুহূর্তে যাত্রী ওঠানামা করছে।
উন্নত বিশ্বের সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন কিভাবে চলে সে উদাহরণ না টেনেই বলা যায়, আমাদের মতো বেশি জনসংখ্যার অনুন্নত দেশে বাস-ট্রাক কিভাবে চলে, তা নিশ্চয়ই সড়ক পরিবহনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্তৃপক্ষের জানা আছে। বিআরটিএ, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও যানবাহন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশের কর্তারা বিদেশের পরিবহনব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করতে যান, অনেকে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণও নিয়ে এসেছেন। তাঁরা কি দেশে ফিরে তাঁদের সেই শিক্ষা কাজে লাগানোর কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন? স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তকমা লাগানো এই দেশে, বিশেষ করে দেশের রাজধানী শহরে উন্নত আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় না—এ কথা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। লাইসেন্সবিহীন চালক, ফিটনেস ও রুট পারমিটবিহীন গাড়ি চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা, নির্ধারিত স্ট্যান্ড ছাড়া যাত্রী ওঠানামা অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা এবং স্টপেজে যাত্রী তোলার জন্য দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে পরবর্তী বাসের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া বন্ধ করার দাবি কোনো অযৌক্তিক দাবি নয়। পাশাপাশি প্রতিটি ট্রাফিক সিগন্যালের জেব্রাক্রসিংয়ের ওপর এসে গাড়ি দাঁড়ানো বন্ধ করা, ফুটপাত দখলমুক্ত করে এবং ফুটপাতে মোটরসাইকেল চালানোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে হেঁটে চলার পথ সচল রাখার মতো সামান্য বিষয়গুলো বাস্তবায়নেও সরকারের সদিচ্ছার অভাবই প্রধান।
সম্প্রতি দেশের সড়ক-মহাসড়কে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডগুলো নিছক দুর্ঘটনা ভাবার কোনো কারণ নেই। এসব ঘটনার প্রতিটি ক্ষেত্রেই চালকের অদক্ষতা, দায়িত্বহীনতা, ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা এবং অসহিষ্ণুতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তার ক্রমবর্ধমান আত্মবিশ্বাস। যেকোনো পরিস্থিতিতে শ্রমিক সংস্থা ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের শর্তহীন সমর্থন এবং আইনের দ্বারা অপরাধের শাস্তি বিধানের সম্ভাবনা প্রায় না থাকার ফলে নিজের নিরাপত্তার প্রতি উদ্বেগহীন আস্থা তাদের বেপরোয়া করে তুলেছে। সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাইদুর রহমান পায়েল হত্যার বিবরণ যেকোনো সুস্থ বিবেকসম্পন্ন মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। হানিফ পরিবহনের গাড়িটির চালক, সুপারভাইজার ও তার সহকারীর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তারা শুধু একজন আহত যাত্রীকে বহনের ঝামেলা এড়ানোর জন্য নদীতে ফেলে দিয়ে তাঁকে হত্যা করেছে। এই মর্মান্তিক ঘটনার স্মৃতি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই রবিবার শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীকে বাসচাপা দিয়ে খুন করেছে জাবালে নূর পরিবহনের চালক।
দীর্ঘদিন ধরে সড়কে-রাজপথে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার কারণ পরিবহন শ্রমিকদের জাতীয় নেতার আকর্ণ বিস্তৃত হাসির মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। তিনি বরাবরই সড়কে দুর্ঘটনা ও হত্যায় দায়িত্বহীনভাবে চালক ও সহকারীর শাস্তির বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে প্রকৃতপক্ষে নৈরাজ্য ও স্বেচ্ছাচারকেই উসকে দিয়েছেন। ফলে সহপাঠী হত্যার প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসে ঢাকা শহরের বিপুলসংখ্যক স্কুল-কলেজের হাজারো শিক্ষার্থী। তারা নিশ্চিত জানে, প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে স্থায়ীভাবে নৈরাজ্য দূর করা সম্ভব না হলে একজন অসুস্থ যাত্রীকে যেকোনো চালক মাঝপথে নদীতে ফেলে দিতে পারে। দাবি করা বেশি ভাড়া না দিলে বাস কন্ডাক্টর তাদের লাথি দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিতে পারে। পরিবহন শ্রমিকের সঙ্গে সামান্য কারণে বচসায় জড়িয়ে পড়লে তারা দলবলসহ ছাত্র-জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। সর্বোপরি তারা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়, অদক্ষতা বা অক্ষমতার কারণে, এমনকি শুধু বাহাদুরি দেখানোর জন্য যেকোনো পথচারী, রিকশাযাত্রী বা মোটরবাইক আরোহীকে চাপা দিতে পারে। তারা জানে শেষ পর্যন্ত কেউ তাদের চুলের আগাটিও স্পর্শ করতে পারবে না। অতীতে কেউ পারেনি এবং ভবিষ্যতেও পারবে না। অতএব, দ্বিধাহীনচিত্তে রাজপথে মানুষ চাপা দেওয়ার খেলায় মেতে উঠতে তাদের ঠেকাবে কে!
কিশোর-তরুণদের এই প্রতিবাদ সংগত কারণেই সব স্তরের চাকরিজীবী, ছাত্র-শিক্ষক, গৃহবধূ ও পেশাজীবী মানুষের সমর্থন লাভ করেছে। ছাত্রদের সড়ক অবরোধের ফলে রাস্তায় যানজটে দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। কিন্তু বহুকাল পরে এবারই প্রথম পথের দুর্ভোগ মেনে নিয়ে বাসযাত্রী বা পথচারীরা ছাত্র-ছাত্রীদের এই বিক্ষোভ সমাবেশ এবং অবরোধকে সমর্থন দিয়েছে।
সরকারের মন্ত্রী-সান্ত্রি-সচিব কিংবা পুলিশের বড় কর্তা পর্যায়ে এমন বিবেকবান যুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন কোনো মানুষ কি নেই, যিনি এসব শিশুর সামনে দাঁড়িয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আস্থার সঙ্গে বলতে পারেন, ‘তোমাদের সহপাঠীর মর্মান্তিক মৃত্যুতে আমরাও ব্যথিত ও দুঃখিত। তোমরা ঘরে ফিরে যাও, আমরা এই দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর বিচার করব এবং ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে তার জন্য যথাযথ আইন প্রণয়ন এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করব।’ যদি সত্যি সরকারের দলে, মন্ত্রিসভায় কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো কোনায় তেমন কেউ না থাকেন, তাহলে সরকারের উন্নয়ন দিয়ে আমরা কী করব? বিক্ষুব্ধ শিশুদের লাঠিপেটা করে পুলিশ নিশ্চয়ই তাদের সড়ক থেকে সরিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু তাদের কৈশোর ও তারুণ্যের ওপর এই নিষ্ঠুরতার বিরূপ প্রতিক্রিয়া যে স্থায়ী ছাপ ফেলে যাবে, তা মুছে ফেলা কোনো শক্তিশালী বাহিনীর পক্ষেই সম্ভব হবে না। সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ না নিয়ে পেশিশক্তি দিয়ে বিক্ষোভ দমনের ফলাফলও কিন্তু সুদূরপ্রসারী এবং মারাত্মক হতে পারে।
লেখক : সাবেক উপমহাপরিচালক, বাংলাদেশ টেলিভিশন
সৌজেন্যে: কালের কণ্ঠ