অর্ধেক আসন খালি রাখাসহ ১১ শর্তে আগামী সোমবার থেকে দূরপাল্লা ও নগর পরিবহন বাস চলবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিনিময়ে দ্বিগুণ ভাড়া চান বাস মালিকরা। আজ শনিবার ব্যয় বিশ্নেষণ কমিটির সভায় ভাড়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। তবে ট্রেন ও লঞ্চ চলাচল আগামীকাল রোববার থেকে শুরু হচ্ছে।
করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন পরিচালনার শর্ত নির্ধারণে গতকাল শুক্রবার বনানীতে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) প্রধান কার্যালয়ে সভা হয়। এতে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষায় ১১ শর্ত নির্ধারণ করা হলেও সেগুলো মেনে বাস চালানো আদৌ সম্ভব কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মালিক-চালকরাই মনে করছেন, বিশেষ করে ঢাকা শহরের অভ্যন্তরীণ রুটের বাসে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা অসম্ভব। বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক পরিবহন নেতা বলেছেন, মাস্ক পরা ছাড়া আর একটি শর্তও বাস্তবে মানা সম্ভব হবে না।
সভায় সভাপতিত্ব করেন সড়ক পরিবহন সচিব নজরুল ইসলাম। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যোগ দেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বিআরটিএর চেয়ারম্যান ইউছুব আলীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও সভায় ছিলেন। সভায় অংশ নেন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খান, সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ, ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী, সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহসহ শীর্ষ পরিবহন নেতারা।
করোনার বিস্তার রোধে গত ২৫ মার্চ থেকে বাস, লঞ্চ, ট্রেনসহ সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ রয়েছে। আগামী সোমবার থেকে আবার গণপরিবহন চালু হচ্ছে। তবে সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, সীমিত আকারে এ কার্যক্রম চলবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাত্রী পরিবহন করতে হবে।
বিআরটিএর সভায় সিদ্ধান্ত হয়, বাস টার্মিনালে ভিড় করা যাবে না, তিন ফুট দূরত্ব বজায় রেখে লাইন ধরে টিকিট কাটতে হবে, বাসে ওঠার আগে শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা ও হাত ধুতে হবে, বাসে স্যানিটাইজার রাখতে হবে, দাঁড়িয়ে যাত্রী নেওয়া যাবে না, ৫০ ভাগ আসন ফাঁকা রাখতে হবে, চালক-শ্রমিক ও যাত্রীকে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে, যাত্রার আগে ও পরে বাস জীবাণুমুক্ত করতে হবে, চালক-শ্রমিককে একটানা ডিউটি দেওয়া যাবে না, মহাসড়কে বিরতি দেওয়া যাবে না এবং মালপত্র জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
এর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কারিগরি কমিটি গণপরিবহন ও ট্রেনে যাত্রী পরিবহনে ১৪ শর্ত দিয়ে নির্দেশিকা জারি করেছিল। বিআরটিএর চেয়ারম্যান ইউছুব আলী মোল্লা জানিয়েছেন, সীমিত আকারে গণপরিবহন চালু করতে কারিগরি কমিটির সুপারিশকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
ভিডিওতে যুক্ত হয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, সামাজিক দূরত্ব রক্ষায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ আসন ফাঁকা রাখা যেতে পারে। যাত্রীরা একই পরিবারের হলে পাশাপাশি আসনে বসতে পারবে। তবে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, যাত্রীরা পরস্পরের আত্মীয় কি না, তা চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। আবার করোনার কারণে একক যাত্রীই বেশি হবে। তাই সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে অর্ধেক আসন খালি রাখতে হবে। দূরপাল্লার ৪০ আসনের বাসে সর্বোচ্চ ২০ জন যাত্রী নেওয়া হবে। নগর পরিবহনে ৩২ আসনের মিনিবাসে ১৬ জন এবং ৫২ আসনের বাসে ২৬ জন যাত্রী নেওয়া যাবে।
অর্ধেক আসন খালি রাখার শর্তে ভাড়া দ্বিগুণ করার প্রস্তাব দেন মালিকরা। যেমন- ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত সরকার নির্ধারিত ভাড়া ২২০ টাকা। মালিকদের প্রস্তাব অনুযায়ী তা ৪৪০ টাকা হবে। ফার্মগেট থেকে মিরপুর ১০ নম্বরের ভাড়া ১২ টাকা। মালিকদের প্রস্তাব গৃহীত হলে এ ভাড়া ২৪ টাকা হবে। আজ বিআরটিএর ব্যয় বিশ্নেষণ কমিটিতে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে বলে জানিয়েছেন খন্দকার এনায়েত উল্যাহ।
ভাড়া বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি দিয়ে খন্দকার এনায়েত বলেন, দূরপাল্লার বাসে আসনসংখ্যার ভিত্তিতে ভাড়া নির্ধারিত হয়। তাই যেহেতু অর্ধেক আসন খালি রাখতে হবে, তাই ভাড়া দ্বিগুণ হওয়া উচিত।
ভাড়া নির্ধারণ করে সরকারের ব্যয় বিশ্নেষণ কমিটি। ৩০ শতাংশ আসন খালি ধরে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। করোনার কারণে ৫০ শতাংশ আসন খালি রাখার শর্ত দেওয়া হয়েছে। এ হিসাবে ২০ ভাগ আসন বেশি খালি রাখতে হবে। এর জন্য ভাড়া দ্বিগুণ করার শর্ত যৌক্তিক কি না- এ প্রশ্নের জবাবে খন্দকার এনায়েত বলেছেন, পাঁচ বছরে এক পয়সা ভাড়া বাড়েনি। ভাড়া বাড়লে এখন বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ত না। ৩০ শতাংশ আসন খালি ধরে ভাড়া নির্ধারণ করা হলেও যাত্রী তুলতে তো বাধা নেই। কিন্তু এখন বাধ্যতামূলকভাবে অর্ধেক সিট খালি রাখতে হবে।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্ত আদৌ মানা হবে সম্ভব কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে মালিকদের মধ্যেই। বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন মালিক বলেন, দূরপাল্লার বাসে যাত্রীদের পরখ করে নেওয়া যাবে। মালিক চেষ্টা করলে নজরদারি করে অর্ধেক সিট খালি রাখতে পারবে। কিন্তু বাসে ওঠার আগে হাত ধোয়া, জীবাণুমুক্ত করা- এগুলো যাত্রীদের ওপর নির্ভর করে। আর নগর পরিবহনে এগুলো কোনোভাবেই মানা সম্ভব নয়।
যাত্রীদের বিনামূল্যে মাস্ক ও গ্লাভস দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হলে এর বিরোধিতা করেন মালিকরা। মালিকরা বলেন, চালক-শ্রমিকের সুরক্ষা সরঞ্জাম দেবেন তারা।
করোনাকালে মহাসড়কে গাড়ি থামিয়ে কাগজপত্র পরীক্ষা বন্ধ করার দাবি জানান মালিকরা। সড়ক পরিবহন সচিব বলেন, এমন সিদ্ধান্ত নিলে অবৈধ যানবাহন চলাচল করবে। পুলিশ সীমিত আকারে গাড়ির কাগজ পরীক্ষা করবে। মালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সচিব জানান, মহাসড়কে চাঁদাবাজি বন্ধে পুলিশ তৎপর থাকবে।
লঞ্চ পরিবহন :বিদ্যমান ভাড়ায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে আগামীকাল রোববার থেকে লঞ্চ চলাচলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। শুক্রবার বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। এতে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর সৈয়দ আরিফুল ইসলাম, লঞ্চ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল (যা-প) সংস্থার চেয়ারম্যান মাহবুব উদ্দিন আহম্মদ বীরবিক্রম, লঞ্চ মালিক সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি শহিদউদ্দিন ভূঁইয়াসহ সংশ্নিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকের শুরুতে লঞ্চ মালিকরা বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরে ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব করেন। এ সময় বিআইডব্লিউটিএ ও নৌপরিবহন অধিদপ্তর বিদ্যমান আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী যাত্রীদের প্রাপ্য স্থান দেওয়ার অনুরোধ জানায়। বৈঠকে লঞ্চের সার্ভে সনদে উল্লেখিত সংখ্যক যাত্রী বহনের সিদ্ধান্ত হয়। কোনো লঞ্চ অতিরিক্ত যাত্রী বহন করছে কি না, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছে কিনা, তা মনিটরিংয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকের একপর্যায়ে লঞ্চ মালিক শহিদউদ্দিন ভূঁইয়া বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক পর্যায়ের এক কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে কর্মকর্তাদের ঘুষের পরিমাণও বেড়ে গেছে- এমন বক্তব্য দিলে বৈঠকে চরম হৈচৈ ও বিতর্ক তৈরি হয়।