জঙ্গিবাদের কেন্দ্রস্থল ছিল রাজধানীর লেকহেড গ্রামার স্কুল। বিভিন্ন সময়ে এই স্কুলের অন্তত ১২ জন শিক্ষকের জঙ্গিবাদে যুক্ত থাকার প্রমাণ পেয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
তাঁদের কয়েকজন এখনও পালিয়ে রয়েছেন। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে স্কুলটির বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদে মদদ দেওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। এই স্কুলের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর নজরদারি করছে গোয়েন্দারা। দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণে রাখার পর গত সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুলটি বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল মঙ্গলবার স্কুলের তিনটি শাখা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
গত রাতে গুলশান থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক বলেন, মেজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে বিকেলে বনানীর শাখাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেখানে পুলিশও ছিল। ধানমণ্ডি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) পারভেজ ইসলাম বলেন, ‘ধানমণ্ডির ওই স্কুলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমরা ম্যাজিস্ট্রেটকে সহায়তা করেছি।
’
জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িত থাকায় গত ৬ ফেব্রুয়ারি স্কুলটির ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তদন্ত শেষে স্কুলটি বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। গত সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সালমা জাহানের সই করা এক চিঠিতে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি সরকারের অনুমোদন নেয়নি। এ ছাড়া এই প্রতিষ্ঠান ধর্মীয় উগ্রবাদ, উগ্রবাদী সংগঠন সৃষ্টি, জঙ্গি কার্যক্রমে পৃষ্ঠপোষকতাসহ জাতীয় ও স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত। তাই ঢাকা জেলা প্রশাসনকে স্কুলটি বন্ধ করে দিতে বলা হয়।
তবে গতকাল দুপুরে স্কুল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে তাদের ফেসবুক পেজে এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘মিডিয়ায় বিভিন্ন খবর প্রকাশিত হলেও আমরা এখনো কোনো অফিশিয়াল পত্র পাইনি। আর পাওয়ার পর এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। ’ তাই অভিভাবকদের বিভ্রান্ত না হতে বিজ্ঞপ্তিতে অনুরোধ জানানো হয়। তবে বিকেলের দিকে ঢাকা জেলা প্রশাসন স্কুলটি বন্ধ করে দেয়।
ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইলিয়াস মেহেদী বলেন, ‘স্কুলটির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি তাদের হেড অব অ্যাডমিনের জিম্মায় দিয়ে সকল কার্যক্রম বন্ধের জন্য মুচলেকা নিয়েছি। বুধবার থেকে তারা কোনো কার্যক্রম করবে না বলে প্রত্যয়ন করেছে। ’
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, লেকহেড গ্রামার স্কুলের অধ্যক্ষ ছিলেন জেনিফার আহমেদ। তিনি বাংলাদেশে হিযবুত তাহ্রীর সংগঠিত করার অন্যতম প্রধান ব্যক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গোলাম মাওলার স্ত্রী। জেনিফার নিজেও হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০০৯ সালে হিযবুত তাহ্রীর নিষিদ্ধ হওয়ার পর এই স্কুল প্রথম আলোচনায় আসে। ওই বছরই স্কুলটি পরিচালনার পূর্ণ দায়িত্ব নেন হারুন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের কর্ণধার হারুন অর রশিদ ও তাঁর ছেলে রেজওয়ান হারুন। জঙ্গি পৃষ্ঠপোষকতায় অভিযুক্ত রেজওয়ান বেশির ভাগ সময় লন্ডনে থাকলেও গত ২৭ জানুয়ারি থেকে প্রকাশ্যে চলাফেরা বন্ধ করে আত্মগোপন চলে যান। তিনি লন্ডনে চলে যান। গত ১২ মে ঢাকায় আসেন রেজওয়ান। এর পর থেকে নিখোঁজ। তবে স্বজনদের দাবি, বনানী এলাকা থেকে এক দল লোক তাঁকে তুলে নিয়ে গেছে। রেজওয়ান হারুন বাংলাদেশি দুটি পাসপোর্ট একসঙ্গে ব্যবহার করেন। তাঁর একটি পাসপোর্টের নম্বর বিএইচ ০৬৩৪১৩৭। ২০১৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ইস্যু হওয়া এই পাসপোর্টের মেয়াদ ছিল ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ পর্যন্ত। তাঁর আরেকটি পাসপোর্ট নম্বর ৬০১৬৯৩৩। ২০১২ সালের ১২ নভেম্বর ইস্যু হওয়া ওই পাসপোর্টের মেয়াদ রয়েছে আগামী ১১ নভেম্বর পর্যন্ত। রেজওয়ান হারুনের বিরুদ্ধে ঢাকার সামুরাই কনভেনশন সেন্টারে প্রচলিত ইসলামী রীতির বিরুদ্ধে গিয়ে এক দিন আগে ঈদের জামাত এবং বাসায় জুমার নামাজ আদায় করার রীতি প্রচলন করার চেষ্টার অভিযোগও রয়েছে।
লেকহেডের ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘স্কুলটির বিষয়ে আমাদের আগে থেকেই নজরদারি আছে। এই স্কুলের সঙ্গে জড়িত ছিল এমন কিছু ব্যক্তি দেশের বাইরে চলে গেছে। যারা আত্মগোপনে আছে তারাও ভয়ংকর জঙ্গি। আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এসব জানিয়েছি। এখন তেমন তৎপরতার তথ্য না থাকলেও স্কুলটি চলাটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ’
জঙ্গি বিষয়ে তদন্ত করেন এমন একাধিক কর্মকর্তা জানান, লেকহেড গ্রামার স্কুলে শিক্ষক ছিলেন আলোচিত রাজীব করিম, তাঁর ভাই তেহজিব করিম, তেহজিবের স্ত্রী সিরাত করিম এবং তাঁদের সহযোগী মাইনুদ্দিন শরীফ। রাজীব করিম যুক্তরাষ্ট্রগামী ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ফ্লাইট উড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ২০১০ সালে ইয়মেনে আল-কায়েদাবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তেহজিব করিম। এ ছাড়া পরিবারসহ সিরিয়ায় চলে যাওয়া মাইনুদ্দিনের ভাই রেজওয়ান শরীফও লেকহেডের শিক্ষক ছিলেন।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আধ্যাত্মিক নেতা কারাবন্দি জসিমউদ্দিন রাহমানী, আনসারুল্লাহর আরেক শীর্ষস্থানীয় নেতা রেজওয়ানুল আজাদ রানা, পাকিস্তানে গ্রেপ্তার হওয়া বাংলাদেশি জঙ্গি ইফতেখার আহমেদ সনি, জঙ্গি কার্যক্রমে অভিযুক্ত ও নিখোঁজ হওয়া ফারজাদ হক তুরাজ, জুবায়েদুর রহমান, তাসনুভা হায়দার, ইয়াসিন তালুকদার ও আরিফুর রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে রেজওয়ানের। তাঁরা সবাই বিভিন্ন সময়ে রেজওয়ান হারুনের লেকহেড গ্রামার স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। এমনকি হলি আর্টিজানে হামলাকারীদের প্রশিক্ষণদাতা সাবেক মেজর জাহিদুল ইসলামও লেকহেড গ্রামার স্কুলে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করতেন। গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর রূপনগরে জঙ্গিবিরোধী এক অভিযানে জাহিদ মারা যান।
সিটিটিসি ইউনিট সূত্রে জানা যায়, রেজওয়ানই প্রথম উচ্চবিত্ত পরিবারের তরুণদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করার কাজ করেন। তাঁর নির্দেশনায় কায়াকুশিন নামের একটি মার্শাল আর্ট শেখার প্রতিষ্ঠানে জঙ্গিরা প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে। ওই প্রতিষ্ঠানে মার্শাল আর্ট শিখতে গিয়েই গত বছরের ডিসেম্বরে বনানীর সাঈদ আনোয়ার খান নামের এক তরুণ নিখোঁজ হয়। রেজওয়ান ব্রিটেনে থাকা অবস্থায় জামায়াতুল মুসলেমিন নেতা আবু ইসা আল রাফাইয়ের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হন। ২০০২ সাল থেকে তিনি বাংলাদেশে জামায়াতুল মুসলেমিন সংগঠিত করার কাজ করেন। আল-কায়েদার অনুসারী জামায়াতুল মুসলেমিন বাংলাদেশে উচ্চবিত্ত তরুণদের দলে ভেড়ানো শুরু করে। জামায়াতুল মুসলেমিন প্রথমে দেশের ১৩ জেলায় কার্যক্রম শুরু করে।