৫০ বছর বয়সে বর্ণমালা শিখলেও ঘরে-বাইরে সাবলীল সাক্ষর মায়েরা - দৈনিকশিক্ষা

৫০ বছর বয়সে বর্ণমালা শিখলেও ঘরে-বাইরে সাবলীল সাক্ষর মায়েরা

মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি |

মাত্র তিন বছর আগের কথা। স্বাক্ষর দিতে না পারায় ভোটার আইডি কার্ডে স্বাক্ষরের ঘরে দিতে হয়েছে আঙ্গুলের ছাপ। ব্যাংক হিসাব করতে স্বাক্ষর জানতে হবে, তাই খুলতে পারেননি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। ইউনিয়ন পরিষদে সামাজিক নিরাপত্তার সুবিধা এবং অফিস-আদালতে কাজে গেলেই স্বাক্ষর দিতে হবে, এ লজ্জায় ঘর থেকে বের হতেন না। সেই সাক্ষর জ্ঞানহীন মায়েরা বর্ণমালা ও স্বাক্ষর শিখে ঘরে ও বাইরে এখন সাবলীল। নিজেদের জানার আগ্রহের সাথে সাথে ঘরে ও বাইরে সন্তান, নাতি-নাতনীদের গৃহশিক্ষায়ও তারা এখন সহায়তা করছেন। সোচ্চার হয়েছেন বাইরের সকল সামাজিক অনিয়মের বিরুদ্ধে। 

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ১২টি ‘সাক্ষর মা’ স্কুলের নিরক্ষর ২৬৪ মা বর্ণমালায় আলো ছড়িয়ে এখন স্কুলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে যেমন ভূমিকা রাখছেন, তেমনি বাল্যবিবাহ, নারী নির্যাতন, যৌতুক ও তালাক বন্ধে সোচ্চার হয়েছেন ১৮-৫০ বছর বয়সী এই মায়েরা, তিন বছর আগেও যারা সবাই ছিলেন নিরক্ষর।

শৈশবে কেউ স্কুলের বারান্দায় যেতে পারেনি আর্থিক দৈন্যতা, পারিবারিক অসহযোগিতা ও কন্যা হয়ে জন্মগ্রহণ করার কারণে। পারিবারিক দৈন্যতায় শিক্ষার আলোবঞ্চিত এ মায়েদের বর্ণমালার সাথে পরিচিতি করতে একটি বেসরকারি সংস্থা (বয়স্ক সাক্ষরতা কার্যক্রম) কলাপাড়ায় চালু করে ‘স্বাক্ষর মা’ স্কুল।
 
২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে শেষ হওয়া এই ‘সাক্ষর মা’ স্কুলে নীলগঞ্জ ইউনিয়নের ছয়টি স্কুলে ১৩০ জন ও ধুলাসার ইউনিয়নে ছয়টি স্কুলে ১৩৪ জন নিরক্ষর মা এই প্রকল্পের আওতায় শিক্ষার আলোতে এসেছেন। বার্ধক্যে এসে স্বাক্ষর শেখা ও বর্ণমালা পরিচয়ে সামাজিক শিক্ষার আলোতে আসা এ মায়েরা এখন সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখছে নিজ সংসার ও প্রতিবেশীদের সহায়তার মাধ্যমে।

কলাপাড়ার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের নেয়ামতপুর গ্রামের জীবনতরী বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্রের সাক্ষর মায়েরা এখন তাদের অবসর কাটান লাইব্রেরিতে। নাতি-নাতনী, সন্তান নিয়ে দুপুরের অবসরে বক্স লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে তারা পাঠদান করেন। কেউবা লাইব্রেরিতে বসেই নাতিকে বর্ণমালা শেখান। কেউবা বাড়ির বারান্দায় বসে নিজ সন্তানকে লেখাপড়া শেখান।
 
সবাই দলবদ্ধ হয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন পারিবারিক সমস্যা নিয়ে। যৌতুক, বাল্যবিবাহ, সন্তানদের স্কুলে পাঠানো থেকে শুরু করে প্রতিবেশীদের জমিজমার সমস্যা নিয়েও তারা সোচ্চার। জমির দলিল, বিয়ের কাবিনও তারা এখন পড়তে পারেন কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে। কেউ কেউ নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্রয়-বিক্রয়ের হিসাব ও বাকির খাতা লেখার কাজও করেন।
 
সাক্ষর মায়েদের প্রতিষ্ঠিত ‘জীবনতরী’ লাইব্রেরিতে বসে কথা হয় এই মায়েদের সঙ্গে। তাদেরই একজন সীমা রানী। তিনি বলেন, যখন ছোট ছিলাম আমরা মেয়ে বলে আমাদের পড়ানো হয়নি। কিন্তু আমাদের ভাইদের ঠিকই স্কুলে পাঠিয়েছে বাবা-মা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পা না রাখা এই মায়েরা একটু বড় হলেই তাদের বসতে হয়েছে বিয়ের পিড়িতে। এখন বুঝি, আমাদের লেখাপড়া না শিখিয়ে বাবা-মা কী ভুল করেছেন।

রেভা রানী বলেন, আমার ছোট্ট একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। আগে অক্ষর না জানার কারণে দোকানের হিসাব লিখতে পারতাম না। ‘সাক্ষর মা’ স্কুলে পড়ে এখন বাকির হিসাব যেমন লিখতে পারি, তেমনি দোকানের মালামালের হিসাবও রাখতে পারি।

দুই সন্তানের জননী লাইজু বেগম বলেন, এখন আর কেউ আমাদের ঠকাতে পারছে না। কোনটা জমির দলিল, কোনটা তালাকের কাগজ তা আমরা বুঝতে শিখেছি। না পড়ে টিপসই দেয়ার দিন আর আমাদের নেই। আমরা এখন পড়তে পারি।

অক্ষর না জানার কারণে, সন্তানদের সেই শিশু থেকে ঘরে গৃহ শিক্ষক রেখে পড়াতে হয়েছে। আর এখন আমরা আমাদের নাতি-নাতনীদের নিজেরাই শিখাতে পারি বর্ণমালা। গল্পের বই থেকে গল্প পড়ে শোনাতে পারি। যদি এই বর্ণমালা না শিখতে পারতাম তাহলে হয়তো ঘরে এই নাতি-নাতনীরাও আমাদের দেখে হাসতো। নাতি-নাতনীরা এখন স্কুলে পড়ে। নিজ ছেলে-মেয়েদের স্কুলের কোনো সভা-সমাবেশে তারা যেত না সাক্ষর না জানার লজ্জায়। সাক্ষর মা স্কুলে পড়ে এখন তারা নাতি-নাতনীদের সাথে স্কুলে যান। এ কথা বলেন সাক্ষর মা স্কুল থেকে সাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন জোসনা রানী ও শিবানী রানী। শুধু এই জীবনতরী লাইব্রেরির এই মায়েরা নয়, তাঁদের মতো এখন সচেতন হয়েছে সাক্ষর মা স্কুলের ২৬৪ জন মা।
  
 বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে ঘরে ঘরে মা শিক্ষিত হলে সন্তান শিক্ষিত হয়। এই সন্তানরাই ভবিষতে সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে তাদের উপার্জিত শিক্ষার আলোতে। এতে অন্ধকারাচ্ছন্ন উপকূলের প্রতিটি বাড়ি হবে শিক্ষার আলোতে আলোকিত, যারা এখনও অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে আছে।

প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0086338520050049