৫২ থেকে ৭১ : স্বাধিকার ও স্বাধীনতা - দৈনিকশিক্ষা

৫২ থেকে ৭১ : স্বাধিকার ও স্বাধীনতা

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

আজ অমর ২১শে ফেব্রুয়ারি। বাঙলা ভাষা ও বাঙালি জাতির ইতিহাসে স্মরণীয় এক দিন। স্বর্ণালী এক ইতিহাস। পৃথিবীর বুকে যতদিন বাঙলা ভাষা ও বাঙালি জাতি টিকে থাকবে ততদিন ২১শে ফেব্রুয়ারি অনুপ্রেরণার অন্য এক বাতিঘর হিসেবে শুধু বাঙালি মানসে নয় গোটা দুনিয়ার ভাষাপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবে। একুশকে অনেকে নিছক এক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দিন মনে করে থাকেন। ব্যাপারটি  এমন নয়। একুশ মূলত বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত সকল সংগ্রামের অনুপ্রেরণার সুতিকাগার। আন্দোলন সংগ্রাম কিংবা ত্যাগ তিতিক্ষা ছাড়া জাতীয় জীবনে কিছুই অর্জিত হয় না-সে শিক্ষা আমরা একুশ থেকে পাই। ’৫২ থেকে ’৭১। দুর্দিনের এক দুঃসহ অভিযাত্রা। এ সময়ে জাতিকে দুর্গম বন্ধুর কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। চুয়ান্ন, ছেষট্টি, ঊনসত্তর ও একাত্তরে বায়ান্নই মূল প্রেরণা।

একুশের চেতনায় সে চ্যানেলগুলো সাঁতরে পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছি। এ দীর্ঘ যাত্রায় একুশ কেবল সামনে এগুতে সাহস যোগায়নি, পিছু ফিরে তাকাতেও বাঁধা দিয়েছে। সংগ্রামের পথ ছেড়ে এক পা বিচ্যুত হতে দেয়নি। হাত ধরে মহান একাত্তরে নিয়ে গেছে। ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর। আমাদের এক রক্তাক্ত মহাসাগর সাঁতরে পাড়ি দিতে হয়েছে। সে মহাসগরেও একুশ একমাত্র সহযাত্রী। হাত ধরে রক্তাক্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়েছে এবং আমাদের পাড়ি দিতে উৎসাহ যুগিয়েছে। অনুপ্রাণিতও করেছে।

'৫২-র মহান ভাষা আন্দোলন দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। '৭১-র স্বাধীনতা সংগ্রাম স্বচক্ষে দেখেছি। বয়স একান্ত কম ছিলো বলে মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারিনি। এই কষ্টটা সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হতে পারা কত যে গৌরব ও গর্বের বিষয় তা আমার মতো যারা মুক্তিযোদ্ধা হবার সুযোগ পাননি তাদের পক্ষে বুঝা কঠিন। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। সেই সাত-আট বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ধারণাটি জন্ম নিয়েছিল। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমার একান্ত যে উপলব্ধি সেটি এই-এ জাতি আদি ও অনাদিকালে কোনোদিন তার সূর্য সন্তানদের ঋণ শোধ করতে পারবে না। মহান ভাষা আন্দোলনে যারা আত্মাহুতি দিয়ে গেছেন তারাও জাতির কাছে চির নমস্য। এ জাতি সারা জীবনে তাদের এক বিন্দু রক্তের ঋণ শোধ করে দিতে পারবে না। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গৌরব আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রাম। এ দু'টো ঘটনা বাঙালিকে চিরকাল বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে ধরে রাখবে সন্দেহ নেই।

পৃথিবীতে এমন আরেকটি জাতি খুঁজে বের করা কঠিন হবে যে জাতি মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি উভয়কে মায়ের মর্যাদায় আসীন করতে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সে দিক থেকে বাঙালি এক অসাধারণ সাহসী জাতির নাম। মাতৃভূমির জন্য অনেকে রক্ত দিয়েছে জানি কিন্তু মাতৃভাষার জন্য কারো রক্ত দেবার ইতিহাস জানা নেই। বাঙালির অনেক দুর্দিন গত হয়েছে। অনেক দুর্নাম ঘুচেছে এখন। দুনিয়ার বুকে এখন আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো এক গর্বিত জাতি। একুশ এখন কেবল আমাদের একার নয়। এটি এখন সারা দুনিয়ায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এদিক থেকেও একুশ এখন ভিন্ন মর্যাদায় সারা দুনিয়ার কাছে পরিচিত একটি দিন। আমাদের এখন আরেকটা সৌভাগ্য এই যে, দেশের মাটিতে আমরা স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে অবদমিত করতে পেরেছি। এরা আমাদের বায়ান্ন ও একাত্তরের চেতনাকে কুড়ে কুড়ে খেয়ে ফেলতে শুরু করেছিল।

স্বাধীনতা বিরোধীরা যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে গিয়ে নিজের গাড়িতে জাতীয় পতাকা ওড়ায় সেদিন আমাদের সব চেতনা মরে যেতে বসেছিল। সেদিন জাতীয় পতাকার যে অবমাননা হয়েছিল স্বাধীনতা ও মানবতা বিরোধীদের বিচার করে আমরা এর যথার্থ প্রতিশোধ নিতে পেরেছি। আমাদের জাতীয় পতাকার সে কলঙ্ক আমরা ঘুচে দিতে পেরেছি। আজও সকল দুর্দিন ও দুঃসময়ে একুশ আমাদের জাগিয়ে রাখে। একুশের চেতনায় আমরা বার বার জেগে উঠি। অমানিশার অন্ধকারে একুশ আমাদের সহযাত্রী। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। একুশকে আমরা কতটুকু হৃদয়ে ধারণ করতে পেরেছি? ফেব্রুয়ারি এলে ভাষার চেতনায় উজ্জীবিত হই। সারা ফেব্রুয়ারি জুড়ে ভাষা শহিদদের নিয়ে মাতম চলে। এরপর আর খবর থাকে না। সর্বক্ষেত্রে মাতৃভাষা বাঙলার ব্যবহার আজও নিশ্চিত করা যায়নি। বাঙলা বানান নিয়ে এখনও কত বিকৃতি মেজাজ বিগড়ে দেয়। আমরা এখন একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করি। এটি যে আমাদের অন্যতম জাতীয় শোক দিবস সেটি আমরা অনেকে বিস্মৃত হতে বসেছি। এ বিস্মৃতি মাকে ভুলে মাসীকে মনে রাখার মতো। আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে, মা-ই আমাদের অস্তিত্বের আসল ঠিকানা। মাসী কখনো নয়। একুশকে আমাদের মায়ের মর্যাদায় সারাটি বছর বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

লেখক: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0066189765930176