স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জুবায়ের হাসানের ক্লাস সকাল সাড়ে ১০টায়। তিনি ১০টায় এসে শ্রেণিকক্ষের সামনে অপেক্ষা করছিলেন। কারণ ওই শ্রেণিকক্ষে তখন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের পাঠদান চলছিল।
প্রথম বর্ষের পাঠদান শেষ হতে না হতেই হুড়মুড় করে শ্রেণিকক্ষে ঢুকলেন জুবায়ের। তবু তাঁর জায়গা হলো শেষ বেঞ্চের আগের বেঞ্চে। গাদাগাদি করে ওই বেঞ্চে বসতে হলো সাত সহপাঠীকে। শিক্ষক মাইকে পাঠদান করছিলেন। কিন্তু তাঁরা যে টেবিলে খাতা রেখে নোট নেবেন সে উপায় নেই। অগত্যা শুনতে থাকলেন। শিক্ষকের বত্তৃদ্ধতার কয়েক জায়গায় মনে প্রশ্ন জাগলেও নীরব থাকতে হলো। আসলে ২৫০ শিক্ষার্থীর ৪৫ মিনিটের পাঠ কার্যক্রমে প্রশ্ন করার সময় কই? বৃহস্পতিবার (১৬ মে) দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদটি লিখেছেন শরীফুল আলম সুমন ও তানজিদ বসুনিয়া।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, এ ছাড়া ১১টা বাজতেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দ্বিতীয় বর্ষেরই অন্য শাখার শিক্ষার্থীদের ভিড় জমে গেল শ্রেণিকক্ষের সামনে। সোয়া ১১টায় পাঠদান শেষ হলো, আগের মতোই বেঞ্চ দখলের প্রতিযোগিতার কারণে জুবায়ের আর তাঁর সহপাঠীদের বের হয়ে আসতে হলো ভিড় ঠেলেঠুলে।
জুবায়ের হাসান সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী। গত সোমবার সরেজমিনে ওই কলেজে গিয়ে তাঁর কাছ থেকেই জানা গেল দেশের সবচেয়ে বড় এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণিকক্ষের অভাবে পাঠ কার্যক্রমের এমন বেহাল। কলেজের সামনের মাঠের এক কোনায় দাঁড়িয়ে এ দুই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় জুবায়েরের। তিনি বলছিলেন, ‘দুপুরে আরেকটি ক্লাস আছে। কিন্তু আমাদের ডিপার্টমেন্টের কোথাও যে বসব সে জায়গা নেই। এমনকি সেমিনার হল, গ্রন্থাগারেও বসার জায়গা নেই। তাই বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছি। দুপুরের ক্লাসটা করব কি না ভাবছি।’
রাজধানীর মহাখালীতে ১৯৬৮ সালে প্রায় ১১ একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠা এ কলেজে বর্তমানে শিক্ষার্থীসংখ্যা প্রায় ৫৬ হাজার। শিক্ষার্থীসংখ্যার হিসাবে বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় কলেজ সরকারি তিতুমীর কলেজ। আগের মতো উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক (পাস) শ্রেণি কার্যক্রম নেই। তবু কলেজে শ্রেণিকক্ষের সমস্যা মারাত্মক। রয়েছে শিক্ষক সংকটও। শিক্ষকদের বসার জায়গার যেমন অভাব, তেমনি গ্রন্থাগার ও সেমিনার হলে শিক্ষার্থীদের বসার জায়গারও মারাত্মক সংকট রয়েছে। রয়েছে সেশনজটও।
পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ নেই : জুবায়েরের মতো কলেজের অন্য শিক্ষার্থীরা বলছিলেন, তিতুমীর কলেজের অন্যতম প্রধান সমস্যা শ্রেণিকক্ষের অভাব।
তাঁরা বলছিলেন, প্রতিটি বিভাগে জোড় ও বিজোড় ক্রমিক নম্বরের শিক্ষার্থীদের দুটি শাখায় ভাগ করে পাঠদান করা হয়। প্রতিটি বিভাগের নিজস্ব একটি শ্রেণিকক্ষ ও অন্য বিভাগের একটি শ্রেণিকক্ষ ভাগাভাগি করে চলছে পাঠদান। দিনে দুই পালায় পাঠদান হয়। সপ্তাহে একজন শিক্ষার্থী তিন দিন পাঠ গ্রহণ করতে পারেন।
কলেজ সূত্রে জানা গেছে, তিনটি অনুষদের অধীনে ২২টি বিভাগের এ ৫৬ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য শ্রেণিকক্ষ আছে মাত্র ২৬টি। অর্থাৎ গড়ে দুই হাজার ১৫৩ জনের জন্য বরাদ্দ একটি কক্ষ।
শিক্ষক সংকট : বৈশ্বিক মান অনুযায়ী ৩০ শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক থাকার কথা। কিন্তু দেশের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে সে অনুপাত হলো ৭০ শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক। কিন্তু তিতুমীর কলেজে ৫৬ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক আছেন প্রায় ২০০ জন। অর্থাৎ গড়ে ২৮০ শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক আছেন একজন; যা শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতের দিক থেকে বিশ্বের সর্বোচ্চ। শিক্ষার্থী বেশি হওয়ায় একই বর্ষের শিক্ষার্থীদের দুই ভাগ করা হয়েছে। এতে করে কোনো বিষয়ের একজন শিক্ষককে দুবার পাঠদান করতে হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করে একজন শিক্ষক বলেন, ‘আমার বিভাগের প্রথম বর্ষে সাড়ে ৫০০ শিক্ষার্থী। প্রথম যখন ক্লাস শুরু হয় তখন অর্ধেক শিক্ষার্থীকেই শ্রেণিকক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। পরে আমরা দুই ভাগ করি। এখন শিক্ষার্থীদের দুই ভাগ করলেও শিক্ষক কিন্তু একজন। ফলে আমাকে ডবল ক্লাস নিতে হচ্ছে। আর মফস্বলের কলেজে শিক্ষকরা যে সুবিধা পান, এখানে সেটাও নেই। এর পরও আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, পাঠদানের ফাঁকে তাঁরা যে বসবেন, এর ভালো ব্যবস্থাও নেই। প্রতিটি বিভাগে বিভাগীয় প্রধানসহ সব শিক্ষক একটি কক্ষে গাদাগাদি করে বসেন। শিক্ষকরা কোথায়ও বসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ করবেন, পড়ালেখা করবেন সে সুযোগও নেই। নেই শিক্ষকদের জন্য আবাসন ও পরিবহনব্যবস্থা।
সেশনজট : একটি বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির মোট পাঁচ বর্ষের শিক্ষার্থী থাকার কথা থাকলেও সরকারি তিতুমীর কলেজের প্রায় সব বিভাগে আটটি থেকে ৯টি বর্ষের শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। এর মধ্যে প্রথম বর্ষে দুই (পুরনো প্রথম বর্ষ, নতুন প্রথম বর্ষ) ব্যাচ, শেষ বর্ষে দুই ব্যাচ এবং স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে দুই অথবা তিনটি করে ব্যাচ রয়েছে। ২২টি বিভাগে দ্বিগুণ শিক্ষার্থীর প্রধান কারণ এই সেশনজট। উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক (পাস) কোর্স আগে চালু থাকলেও জট কমাতে বর্তমানে তা বন্ধ করে দিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। তবু শুধু সেশনজটের কারণে শিক্ষার্থীসংখ্যা কমানো যাচ্ছে না।
গণিত প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের অনার্স-মাস্টার্স মিলে পাঁচটি ব্যাচ থাকার কথা, কিন্তু আছে আটটি। সেশনজটের কারণে তিনটি ব্যাচ বেশি আছে। আমাদের এখনো ইয়ার ফাইনাল হয়নি, অথচ সামনে নতুনরা আসছে।’
ফলাফল : রাজধানীর সাত কলেজ প্রায় দুই বছর আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যায়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন পর্যন্ত বিভাগওয়ারি সমন্বিত ফল প্রকাশ করতে পারেনি। এতে কোন বিভাগ কেমন ফল করল তা জানা সম্ভব হচ্ছে না। তবে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যাওয়ার পর কলেজটির ফল আগের চেয়ে কিছুটা নিম্নগামী।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : সরকারি তিতুমীর কলেজের অধ্যক্ষ মো. আশরাফ হোসেন বলেন, ‘আমাদের খেলার মাঠের পাশে ১০ তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে দুটি ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। একটির চারতলা ও অন্যটির দোতলা পর্যন্ত কাজ শেষ হওয়ার পথে। এই দুটি ভবন চালু হলে ক্লাসরুমের সংকটের কিছুটা সমাধান হবে। আর শিক্ষক সংকটের ব্যাপারটি মন্ত্রণালয় পর্যন্ত জানে। কিন্তু পদ সৃষ্টি না হলে নতুন শিক্ষককে পদায়ন দেওয়া সম্ভব নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় নতুন পদ সৃষ্টির ব্যাপারে কাজ করছে।’
অধ্যাপক আশরাফ হোসেন বলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যাওয়ায় কিছুটা গ্যাপ তৈরি হয়েছে। এ কারণে কিছুটা সেশনজট তৈরি হয়েছে। আমাদের এই কলেজটি শুরুতে মূলত পাঁচ-সাত হাজার শিক্ষার্থীর অবকাঠামো নিয়ে গড়ে উঠেছিল। সেই কাঠামোর মধ্য থেকেই আমাদের ৫৬ হাজার শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদান করতে হচ্ছে। এ জন্য কিছুটা সমস্যা হয়। তবে আমাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। যখনই যে সমস্যা আসে আমরা তা সঙ্গে সঙ্গে সমাধানের চেষ্টা করি।’
অধ্যক্ষ আরো বলেন, ‘তিতুমীর কলেজে শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষার্থী কমানোর বিকল্প নেই। আমরা এরই মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক তুলে দিয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ায় ডিগ্রি ও প্রিলিমিনারি মাস্টার্স তুলে দেওয়া হয়েছে। তবে এসব কোর্সে যেসব শিক্ষার্থীর পাঠদান চলমান, তারা পাস করে বেরিয়ে গেলে শিক্ষার্থীসংখ্যা আরো কিছুটা কমবে। তার পরও আমাদের শিক্ষার্থী আরো সীমিত করতে হবে।’