একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্যদের মধ্যে ৬১ শতাংশ ব্যবসায়ী, ১৩ শতাংশ আইনজীবী, ২১ শতাংশ অন্যান্য পেশার এবং মাত্র ৫ শতাংশ রাজনীতিক। আর প্রথম জাতীয় সংসদে মাত্র ১৮ শতাংশ ছিল ব্যবসায়ী।
বর্তমান সংসদে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে ৯২ শতাংশই পুরুষ। বাকি ৮ শতাংশ নারী। সংরক্ষিত আসনসহ শতকরা হিসাবে সংসদে ৭৯ শতাংশ পুরুষ এবং ২১ শতাংশ নারী। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
‘পার্লামেন্টওয়াচ : একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম থেকে পঞ্চম অধিবেশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি গতকাল বুধবার অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। আইন প্রণয়ন, জনগণের প্রতিনিধিত্ব ও সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম থেকে পঞ্চম অধিবেশন প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর ছিল না বলে উল্লেখ করা হয়েছে গবেষণায়। সংসদকে কার্যকর করতে ১২ দফা সুপারিশ দিয়েছে টিআইবি।
গবেষণায় বলা হয়, একাদশ জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ ও তার শরিক দল ৮৯ শতাংশ, প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ৭ শতাংশ এবং অন্যান্য বিরোধী দল ৪ শতাংশ আসনে প্রতিনিধিত্ব করছে। সদস্যদের একাংশ তাঁদের হলফনামায় সম্পদের সঠিক তথ্য প্রদান করেননি এবং ২১ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা ছিল। একাদশ সংসদের পাঁচটি অধিবেশনের ৬১ কার্যদিবসের সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় হয়েছে জনপ্রতিনিধিত্ব ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত কার্যক্রমে, যা প্রায় ৩১ শতাংশ। বাজেট ব্যতীত আইন প্রণয়নে মাত্র ৯ শতাংশ সময় ব্যয় করা হয়েছে।
সরকারদলীয় সদস্যদের বক্তব্যে নিজ সরকারের আমলের বিভিন্ন কাজ ও পদক্ষেপের প্রশংসা প্রাধান্য পেলেও অনিয়ম-দুর্নীতির মতো বিষয়গুলোর গুরুত্ব কম পেয়েছে। অন্যদিকে বিরোধীদলীয় সদস্যদের বক্তব্যে সমসাময়িক বিভিন্ন সমস্যা, যেমন—ব্যাংক খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি, সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি সত্ত্বেও দুর্নীতি হ্রাসে পদক্ষেপের ঘাটতি, আয়বৈষম্য বৃদ্ধি, বেকার সমস্যা, নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের তদন্তভিত্তিক সুপারিশ বাস্তবায়নে পদক্ষেপের ঘাটতি, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’-এর বিতর্কিত ধারাগুলো বাতিলের মতো বিষয় উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বিল উত্থাপন এবং বিলের ওপর সদস্যদের আলোচনা ও মন্ত্রীর বক্তব্যসহ একটি বিল পাস করতে গড়ে ৩২ মিনিট সময় ব্যয় হয়। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতে ২০১৯ সালে ১৭তম লোকসভায় প্রতিটি বিল পাসে গড়ে প্রায় ১৮৬ মিনিট ব্যয় হয়। অধিকাংশ সংসদীয় কমিটিতে বিলের ওপর আলোচনায় ঘাটতি লক্ষ করেছে টিআইবি। মাত্র চার শতাংশ সংসদ সদস্য বিলের ওপর নোটিশ দিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। বাকিদের ভূমিকা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বিল পাসের ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে সরকারি দল একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে। বাজেট আলোচনায় সরকারি ও বিরোধী উভয়দলীয় সদস্যের বক্তব্যেই খেলাপি ঋণ, ব্যাংক খাতে অব্যাহত ভর্তুকি ও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার হ্রাস, অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হলেও তা নীতি-নির্ধারকদের কাছে প্রাধান্য পায়নি। ‘অর্থবিল-২০১৯’-এর ওপর বিরোধীদলীয় সদস্যদের জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাবও কণ্ঠভোটে নাকচ হয়। অন্যদিকে সরকারদলীয় ও প্রধান বিরোধীদলীয় সদস্যদের একাংশ প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা সাদা করার প্রস্তাব সমর্থন করেছে, যদিও তা অনৈতিক, বৈষম্যমূলক ও সংবিধান-পরিপন্থী বলে মনে করে টিআইবি।
সংসদে উপস্থিতির বিষয়ে গবেষণায় বলা হয়, পুরুষ সদস্যদের গড় উপস্থিতি ছিল ২২ শতাংশ, যেখানে নারী সদস্যদের উপস্থিতি ছিল ৮৫ শতাংশ। অন্যদিকে সংসদ নেতা সংসদ অধিবেশনের ৯২ শতাংশ কার্যদিবস এবং বিরোধীদলীয় নেতা ৪৮ শতাংশ কার্যদিবস উপস্থিত ছিলেন। প্রধান বিরোধীদলীয় বা অন্যান্য বিরোধী সদস্যরা সংসদ বর্জন ও ওয়াকআউট করেননি। তবে প্রতি কার্যদিবসে গড়ে ১৯ মিনিট কোরাম সংকট ছিল এবং সার্বিকভাবে মোট কোরাম সংকট ছিল ১৯ ঘণ্টা ২৬ মিনিট, যা মোট সময়ের ১৭.৩ শতাংশ। মোট কোরাম সংকটের প্রাক্কলিত অর্থমূল্য প্রায় ২২ কোটি আট লাখ ৬৩ হাজার ৬২৭ টাকা।
সংসদকে কার্যকর করতে সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ করা, সদস্যদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, সংদসে বিরোধী দলের সদস্যদের অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করা, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাসহ মোট ১২ দফা সুপারিশ করা হয়েছে গবেষণায়।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘অষ্টম ও নবম সংসদে সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি দেশবাসীর কাছে হতাশাব্যঞ্জক একটি বিষয় ছিল। দশম ও একাদশ সংসদে অনেক চড়া দামে বন্ধ হয়েছে। এর জন্য এত বেশি মূল্য দিতে হয়েছে যে মাথা ব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান সংসদে পদ্ধতিগতভাবেই একটি কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে। এর ফলে সংসদ কার্যকর হওয়ার যে মূল সূত্র, একটি কার্যকর বিরোধী দল, তা বর্তমান সংসদে অনুপস্থিত। প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত নির্বাচনের একটি সংস্কৃতি আমাদের এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।’