৭ মার্চের ভাষণ : চেতনার বাতিঘর - দৈনিকশিক্ষা

৭ মার্চের ভাষণ : চেতনার বাতিঘর

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের এদিন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিব তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ দিয়ে গোটা জাতিকে স্বাধীনতার জন্য উন্মাতাল করে তুলেছিলেন। এক অসাধারণ বাগ্মিতা শক্তির অধিকারী বলে সেদিন বক্তৃতা দিয়ে জাতিকে স্বাধীনতার জন্য উন্মাদ করে তুলতে পেরেছিলেন। এ রকম ভাষণ আর কোনো বাঙালি কোনোদিন দিতে পারেনি। অনাগত ভবিষ্যতে আর কেউ দিতে পারবে না। দেবার সুযোগও নেই। এই একটি ভাষণের জন্য মুজিব কেবল দেশের পরিমণ্ডলে নয়, বিশ্ব ইতিহাসে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ইতিহাসের অবিনাশী পৃষ্ঠায় তাঁর নাম যুগ-যুগান্তরে সোনালী অক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে।

ইউনেস্কো ঐতিহাসিক এ ভাষণটিকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্যে’র অংশ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমেরিকার দাস প্রথা বিলুপ্তির জন্য আব্রাহাম লিংকন গেটিসবার্গে যে ভাষণ দিয়ে জাতিকে উন্মাদ করে তুলেছিলেন, বঙবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ এর থেকে কোনো অংশে কম নয়। ক্ষেত্র বিশেষ বেশি গুরুত্ববহ। অপরাপর বিশ্ব নেতার ভাষণ আর শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যে পার্থক্য এই যে, বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ ভাষণটি কোনো লিখিত ভাষণ ছিল না। সে ভাষণের কোনো পূর্ব পরিকল্পনাও ছিল বলে মনে হয় না। সেটি ছিল মুক্তিকামী জনগণের প্রিয় নেতার স্বতঃস্ফূর্ত সাহসী উচ্চারণ। তাঁর চিরাচরিত ভাষণের মতো। দৃপ্ত কণ্ঠে জাতিকে নির্দেশনা দেবার দৃঢ় প্রত্যয়। ভাষণের প্রতিটি ধ্বনি একেকটি পারমাণবিক বোমার শক্তি নিয়ে উচ্চারিত হয়েছে। একেকটি বলিষ্ট উচ্চারণ বক্তাকে যেমন আত্মপ্রত্যয়ীরূপে প্রতিভাত করেছে, তেমনি শ্রোতাদের উজ্জীবিত করেছে। শাসকের চোখ রাঙিয়ে তর্জনি উঁচিয়ে অকুতোভয়ে এমন একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণ আর কোনোদিন কেউ দিতে পেরেছে কি না, সে নিয়ে রীতিমত গবেষণা হতে পারে। কোনো গবেষণায় এ ক্ষেত্রে বঙবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটি পেছনে ফেলার নয়।

সে ভাষণের প্রেক্ষাপটটি একদিনে রচিত হয়নি। বঙবন্ধুর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের পরিক্রমায় ৭ মার্চের অনবদ্য উপস্থিতি জাতির চেতনার চরম উন্মেষ ঘটিয়ে দেয়। দেশকে শত্রুমুক্ত করে পরাধীনতার শৃংখল ভেঙ্গে চুরমার করে দেবার শপথ নিতে অনুপ্রাণিত করে। বঙবন্ধু মুজিবকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ৭ মার্চে এসে উপনীত হতে হয়েছে। বন্ধুর ও দুর্গম পথ মাড়িয়ে অবশেষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসে মুজিব হাজির হয়েছেন। লাখো জনতা কেবল পথ চেয়ে দেখেছে। কণ্টকাকীর্ণ পথ পেরিয়ে কী করে মঞ্চে এসে উপস্থিত হতে পেরেছেন, সে কেবল মুজিব ছাড়া অন্য কেউ অনুধাবন করার কথা নয়।

’৫২, ’৫৪, ’৫৮, ’৬২, ’৬৬, ’৬৯ পেরিয়ে অতঃপর ’৭১। ততদিনে শেখ মুজিবের উপর অনেক ঝড় ঝঞ্জা বয়ে গেছে। অনেক কাঠখড় পুড়ে ছাই ভস্ম হয়েছে। ক্লান্ত শ্রান্ত মুজিব তখনো উদ্যম পায়ে হেঁটে চলেছেন ’৭১-র মার্চের দিকে। ৭ মার্চ-ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মঞ্চের দিকে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে এসেছেন। দশ লাখ মানুষের মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে মঞ্চে উঠেছেন। উদাত্ত কণ্ঠে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণটি শুরু করেন। আবৃত্তি করেন রাজনীতির এক দীর্ঘ কবিতা। আঠারো মিনিটের ভাষণটি শুরু করেন, ‘ভাইয়েরা আমার’ দিয়ে। শেষ করেন, ‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম’ দিয়ে। সেই ভাষণে বাঙালি হৃদয়ে চেতনার এক অগ্নিফূলিঙ্গ জ্বলে উঠে। সেই স্ফূলিঙ্গ থেকে স্বাধীনতার আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত শুরু হয়। সেই অগ্নুৎপাতে আত্মাহুতি দেয় তিরিশ লাখ মানুষ। সম্ভ্রম বিসর্জন দেয় বহু মা বোন। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের এক রক্ত সাগর পাড়ি দিয়ে বন্দরে নোঙর করে জাহাজ। নির্ভিক কান্ডারি শেখ মুজিব ৭ মার্চে উত্তাল সমুদ্রে যে জাহাজটি ভাসিয়ে দেবার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন, ১৬ ডিসেম্বর তা নির্বিঘ্নে বন্দরে পৌঁছে যায়। সেই থেকে বাঙালি আজাদ। বিশ্বের বুকে স্বাধীন এক গর্বিত জাতি। আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চের দিনে স্বাধীনতার মহানায়ক শেখ মুজিবকে জাতি বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করে।

স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। ৭ মার্চের ভাষণে কী স্বাধীনতার ঘোষণাটি খুঁজে মেলে না? এই ভাষণে স্বাধীনতার কোনো কিছু বাদ যায়নি। স্বাধীনতার জন্য যা দরকার, সে ভাষণে বঙ্গবন্ধু সবই বলে দিয়েছেন। তাতে কিছুই অপূর্ণ থাকেনি। স্বাধীনতার জন্য এটি এক চূড়ান্ত ভাষণ ছিল। এদিক থেকেও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অপরাপর বিশ্বনেতার ভাষণ থেকে আলাদা ও স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্টমণ্ডিত।
বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে দুটি সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন। একটি স্বাধীনতার এবং অপরটি মুক্তির। প্রথম সংগ্রামটি সফল হয়েছে। বাঙালি আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো এক স্বাধীন জাতির নাম। কিন্তু সে জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি আজও সুদূর পরাহত। দেশ মধ্যম আয়ের স্তরে উন্নীত হলেও এখনো অনেক মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে। শিক্ষক সমাজসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষ নিজেদের অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত।

৭ মার্চের ভাষণে সব মানুষের অধিকার রক্ষার প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছিল। শেখ মুজিব সব মানুষের সমান অধিকারে বিশ্বাসী হয়ে ৭ মার্চের ভাষণটি দিয়েছিলেন। সে ভাষণটির আবেদন ষোল আনা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। ঐতিহাসিক এ ভাষণটির আবেদন প্রতিফলিত হোক রাষ্ট্রীয় প্রতিটি কাজে- মুজিববর্ষের এ ঐতিহাসিক দিনে এই হোক আমাদের দৃপ্ত শপথ।

লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।

নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0092830657958984