‘অনার্সে ভর্তি হওয়াই ছিল পাপ’ - দৈনিকশিক্ষা

‘অনার্সে ভর্তি হওয়াই ছিল পাপ’

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

সকাল ৭টা। এলার্ম বেজে ওঠে রাকিব হাসানের। ঝটপট উঠে প্রস্তুতি নেয়া শুরু। গোসলের আগে সেভ করে তুলে রাখা কাপড় পরেন তিনি। আছে ইন্টারভিউ। রাকিব থাকেন ফার্মগেইটের একটি মেসে। অনার্স শেষ হয়েছে তার প্রায় ২ বছর। চাকরিহীন অবস্থায় ভয়াবহ দিন পার করছেন তিনি। মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) মানবজমিন পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন পিয়াস সরকার।

পড়েছেন রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কম্পিউটার সায়েন্সে। বাড়ি তার গাইবান্ধা জেলার সাদুল্ল্যাপুরে। বাবা ছিলেন, প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও মা গৃহিণী। সামান্য কিছু আবাদি জমি আর বাবার পেনশনের টাকা দিয়েই চলছে তাদের সংসার। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। আর ছোট বোন পড়ছে ডিগ্রিতে। ভয়াবহ অভাবে কাটে তাদের দিন। এরই মাঝে দিতে হয় রাকিবকে টাকা। রাকিব বলেন, কী করব বলেন? অনার্স শেষ করার পরেও নিজের চলার মতো একটা চাকরি জোটাতে পারছি না। মাঝে-মধ্যে মনে হয় আত্মহত্যা করি।

২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে এইচএসসি পাস করেন রাকিব, ৪ দশমিক ৮০ নিয়ে। এরপর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়েও সুযোগ মেলেনি। ভর্তি হয়েছিলেন কারমাইকেল কলেজ, রংপুরে। সেখানে কিছুদিন পড়লেও মন বসতো না। ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু অসচ্ছল পরিবারটির পক্ষে তা ছিল অসম্ভব। রীতিমতো জোরপূর্বক ভর্তি হন। রাকিব বলেন, বাড়িতে যেয়ে খেতাম না। বাবা-মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতাম। নানা কৌশল অবলম্বন করতাম।

শেষে কিছুটা নিরুপায় হয়েই ভর্তি করিয়ে দেন তারা। রাকিব বলেন, কেন যে ভর্তি হয়েছিলাম? বাবা-মায়ের ইচ্ছা ও সামর্থ্যের বিরুদ্ধে গিয়ে অনার্সে ভর্তি হয়ে রীতিমতো পাপ করেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ বছরে দিতে হয়েছে প্রায় ৬ লাখ টাকা। এ ছাড়াও প্রতিমাসে আমার পিছনে খরচ ছিল প্রায় ১০ হাজার টাকা। বাবাকে বিক্রি করতে হয়েছে ২ বিঘা জমি। যাতে ছিল বাঁশ বাগান। আর ল্যাপটপ কিনে দিতে মা একটা দুগ্ধবতী গরুও বিক্রি করেন।

চাকরির পিছনে ঘুরছেন বছর দু’য়েক হলো। প্রায় প্রতিমাসে প্রায় ৪ থেকে ৫টি ইন্টারভিউ দেন। কিন্তু সোনার হরিণ সমতুল্য চাকরির দেখা মেলে না। এখন কীভাবে কাটছে তার দিন? এই প্রশ্নের জবাবে বলেন, কারো কাছে হাত পেতে চলতে পারলে হয়তো তাই করতাম। বাবা-মায়ের কাছে টাকা নিতাম না। একটি টিউশনি থেকে আসে আড়াই হাজার টাকা। আমার মাসে খরচ প্রায় ৮-১০ হাজার টাকা। বাকি টাকা বাবা পাঠান। আমি জানি কতটা কষ্ট করে আমাকে টাকা পাঠান। আগে মিথ্যা বলেও টাকা নিতাম বিশ্ববিদ্যালয় থাকা অবস্থায়। আর এখন প্রয়োজনের টাকাটাও চাই না। বাবা নিজে থেকেই পাঠিয়ে দেন।

সাবরিনা সুলতানা জ্যোতি। তিনিও মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাড়ি তার নীলফামারী জেলায়। বাবা কৃষক। আর বড় ভাইয়ের আছে একটি ওষুধের দোকান। চার ভাইবোনের পরিবারে লেখাপাড়া করতে পারেননি কেউ। তিনিই একমাত্র শিক্ষিত পরিবারটিতে। অনেক কষ্টে লেখাপড়ার খরচ দিয়েছেন তার পরিবার। এখন তাদের জন্য কিছু করবার পালা। কিন্তু মিলছে না চাকরি। জ্যোতি বলেন, আমার বাবা ও ভাইয়ের কষ্টের টাকায় লেখাপড়া করলাম। আর এখন অনার্স শেষ করার পরেও বেকার ঘুরছি। বাড়িতে সত্যটাও বলতে পারি না।

তিনি আরও বলেন, বাড়িতে জানে- আমি মাস্টার্স পড়ছি। তারা আমার লেখাপড়ার খরচ দেন। আর আমি নিজের টাকায় চলি। এমন অভাগা আমি সত্যটা বলার সাহস পর্যন্ত পাই না। মূলত এখন আমি মাস্টার্সে পড়ার কথা বলেই চলছি। আর চাকরি খুঁজছি।

চাকরির পরীক্ষার অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, কিছুদিন আগে একটি আইটি ফার্মে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তারা লোক নেবে ১০ জন। পরীক্ষা দিয়েছি ৮শ’ ২৬ জন। আর পরীক্ষায় টিকিয়েছিল ৫০ জনকে। এরপর ভাইভার দিন কোনো প্রশ্ন না করেই নাম ঠিকানা শুনেই শেষ করে দেন ভাইভা। বুঝলাম আগে থেকেই লোক নির্বাচন করা ছিল।

এই দু’জনের মতো দেশে লাখো শিক্ষিত বেকারের বাস। মানবেতর জীবন-যাপন করছেন তারা। পারছেন না নিম্নমানের কোনো কাজ করতে। আবার পরিবারের চাপটাও প্রবল। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)’র ‘ওয়ার্ল্ড এম্পপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-২০১৮’- প্রতিবেদনে উঠে আসে বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে। পৌঁছে গেছে ১২ দশমিক ৮ শতাংশে। আর উচ্চ শিক্ষতদের মাঝে বেকারত্ব ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। যা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ২৮টি দেশের মাঝে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

আবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের দেশে বেকার ছিল ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। যা আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পায় ৮৭ হাজার। প্রতিবছর শ্রমবাজারে ১৩ লাখ মানুষ প্রবেশ করে। আর প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারী তরুণ-তরুণীর মাঝে ৪৭ শতাংশই বেকার থেকে যাচ্ছেন। পরিসংখ্যান ব্যুরোর ওই পরিসংখ্যানে আরও বলা হয়, দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটির উপরে। যেখানে কাজ করছেন মাত্র ৫ কোটি ৯৫ লাখ মানুষ।

আর এ বছর শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মুন্নুজান সুফিয়ান সংসদে বলেন, দেশে বর্তমান বেকারের সংখ্যা সংখ্যা ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। এরমধ্যে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ১০ লাখ ৪৩ হাজার। অর্থাৎ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ।

মিজান মোহাম্মদ ইলিয়াস। তার বাড়ি ফরিদপুরে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৬ বছর আগে শেষ করেছেন অনার্স ও মাস্টার্স। আত্মবিশ্বাসী এই তরুণ প্রথম ৩ বছর করেছেন সরকারি চাকরির চেষ্টা। না হওয়ায় যুদ্ধে নামেন বেসরকারি একটা চাকরির জন্য। সোনার হরিণ মেলাতে ব্যর্থ তিনি। বিষণ্নতা নিয়ে তিনি বলেন, আব্বা মারা গেছেন প্রায় ২০ বছর আগে। আম্মা প্যারালাইজ। আম্মা জানুয়ারি মাসে ঢাকায় এসেছিলেন চিকিৎসার জন্য। এমনি হতভাগ্য সন্তান আমি, আম্মার ডাক্তারের ফি টাও দিতে পারি নাই।

সার্টিফিকেট অনুযায়ী বয়স তার ৩০ পেরিয়েছে। বাস্তবে আরও ৩ বছর বেশি। তিনি বলেন, আম্মা বিয়ের জন্য চাপ দিতে দিতে বলাই ছেড়ে দিয়েছেন। এখন কোনোরকম টিউশনি করে দিন কাটছে। কিন্তু কতদিন চলবে এভাবে? বিয়ে করাটাও জরুরি। শারীরিকভাবে সক্ষম হলেও অর্থনৈতিকভাবে অক্ষম। ইলিয়াস ছাত্র জীবনে কখনো নেশার সঙ্গে জড়াননি। তবে এখন সিগারেট তার সঙ্গী। ভুগছেন ভয়াবহ হতাশায়।

কথা হয় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ফাহমিদা আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, সামাজিক-মানসিক প্রশান্তি ও সমাজে টিকে থাকার জন্য একটা সম্মানজনক কাজ খুবই জরুরি। এটি না থাকলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়াটাই স্বাভাবিক। তৈরি হয় বিষণ্নতা। এই বেকারত্বের কারণে নিজেকে গুটিয়ে নেন তারা। পরিচিতজনদের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেন। ফলে সম্ভাবনা তৈরি হয় নেশার জগতে জড়িয়ে পড়ার। দ্বিধাগ্রস্থ, অকারণে রেগে যাওয়া, বিশ্বাসহীনতা ও সর্বোপরি অন্যায় পথে পা বাড়ানোর সম্ভাবনা তৈরি হয় তাদের মধ্যে।

এমন আরেক শিক্ষিত বেকার রবিন চৌধুরী। তিনি আগে ঢাকায় একাই একরুম নিয়ে থাকতেন। বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ছিলো তার আড়ম্বরপূর্ণ জীবন। এরপর অনার্স শেষ করবার পর মেলাতে পারেননি কোনো চাকরি। বাড়ি থেকে বন্ধ হয়ে যায় টাকা পাঠানো। পড়েন অথৈ সাগরে। শুরু করেন বন্ধু, পরিচিত, আত্মীয়-স্বজনদের থেকে টাকা নেয়া। এভাবে বছর খানেক যাবার পরও চাকরির দেখা না মেলায় শুরু করেন জুয়া খেলা। বিক্রি করতে থাকেন ল্যাপটপ, মোবাইলসহ বিভিন্ন পণ্য। অসম্ভব হয়ে পড়ার পর ঢাকা ছেড়ে চলে যান নিজ বাড়িতে। পাবনা জেলার আলীবন্দি নামক বাজারে যোগ দেন বাবার ইটের সরবরাহের ব্যবসায়।

তিনি বলেন, বাবা এইচএসসি’র পর দুবাই পাঠাতে চেয়েছিলেন। আমি যাইনি। আমি পড়ালেখা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কী লাভ হলো? প্রায় ১২ লাখ টাকা খরচ করে শূন্য হাতে ফিরতে হলো বাড়িতে।চাকরির যুদ্ধে নাম লিখিয়েছেন স্মিতা সাহা চৈতী নামের আরেক শিক্ষিত বেকার। চৈতীর বিয়ে হয়েছিল কিন্তু সংসার করা হয়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃ-বিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স করেন তিনি। শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় বিয়ে ও বিচ্ছেদ হয় তার। এরপর চলে আসেন ঢাকায়। এখন শুধুই চাকুরির পেছনে ছোটা। তিনি বলেন, বাড়ি থেকে মাসে আমাকে পাঠায় মাত্র ৫ হাজার টাকা। আর ২টা টিউশনি থেকে পাই সাড়ে তিন হাজার টাকা। মেস ভাড়া ও আনুষঙ্গিক খরচে চলে যায় প্রায় ৫ হাজার টাকা। টাকার অভাবে মেসে একবেলা খাই। দুপুরের খাবারটাই বাধ্য হয়ে ২ বেলা খাই। অর্ধাহারে কাটছে দিন। তিনি আরো বলেন, আমি থাকি আদাবর ১৩ নম্বরে। সেখান থেকে মোহাম্মদপুর ইকবাল রোডে পড়াতে হেঁটেই যাতায়াত করি। মাসের টাকা হাতে আসতে আসতে হয়ে যায় প্রায় ৭ তারিখ। শেষের দিকে ১০ দিনের মতো চলাচল করতে হয় টাকা ছাড়াই।

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0074691772460938