ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অভিধার ‘ক্ষুদ্র’ শব্দটিতে আপত্তি জানালেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা। বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতীয় সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। এটা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু ক্ষুদ্র শব্দটিতে আমাদের অনেকে কষ্ট পান।’
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের বঙ্গবন্ধু চেয়ার ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেনও প্রশ্ন তুললেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অভিধাটি কতটুকু যুক্তিসংগত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত গারো কমিউনিটির এক ছাত্রীর মন্তব্য, ‘আমি নিজেকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্য বলে পরিচয় দিতে চাই না।’ নারী নেত্রী ও মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির বললেন, ‘যদিও বিতর্ক রয়েছে, তবু আমি ওদের আদিবাসী বলতেই অভ্যস্ত।’
বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) ঢাকায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) আয়োজিত ‘জাতীয় সংস্কৃতি বিকাশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ঐহিত্য সংরক্ষণের গুরুত্ব ও প্রতিবন্ধকতা’ শীর্ষক সেমিনারে অংশগ্রহণকারীদের একাংশের বক্তব্যে এই আপত্তির বিষয়টি উঠে আসে। আবার অন্যদিকে পার্বত্য তিন জেলায় বসবাসকারী বাঙালিদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘এ তিন জেলায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৩ নয়, ১৪। যে একটি নৃগোষ্ঠীকে সেখানে সুবিধাবঞ্চিত করে রাখা হয়েছে, সেটি হচ্ছে বাঙালি। এই তিন জেলায় বসবাসকারী বাঙালিদেরও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মর্যাদা দিয়ে অন্যদের মতো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হোক।’
বিআইআইএসএস অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত সেমিনারে এমন প্রশ্নও করা হয় যে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া আরো কয়েকটি জেলায়ও রয়েছে। কিন্তু আলোচনা শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েকটি নৃগোষ্ঠীকে নিয়ে কেন?
সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। তিনি বলেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে অসচ্ছল কোনো সাংস্কৃতিক কর্মী আমাদের মন্ত্রণালয়ে কোনো সহায়তার জন্য আবেদন করলে তাঁদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
বিআইআইএসএসের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম আব্দুর রহমানের সভাপতিত্বে ও সঞ্চালনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। অন্যদের মধ্যে রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. প্রনানেন্দু বিকাশ চাকমা, বান্দরবান রিজিয়নের রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খন্দকার মো. শাহেদুল এমরান, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. মেসবাহুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট ইয়াকুব আলী চৌধুরী প্রমুখ বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় অংশ নেন।
মূল প্রবন্ধে সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, সংস্কৃতির কোনো চূড়ান্ত রূপ বা সংজ্ঞা নেই। এটি মানবীয় এবং গতিশীল। বাংলাদেশের জনভিত্তিক মানচিত্র না জেনে এ দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মানচিত্রটি কেমন, তা জানা যাবে না। তিনি বলেন, বাঙালি নিজেরাই একটি মিশ্র বা সংকর জাতি। তাদের সঙ্গে এ দেশে প্রায় ৫০টির মতো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে। এ দেশের জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে মিশ্র। সমজাতি নয়। এ অবস্থায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অভিধাটি কতটা যুক্তিযুক্ত?
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন আরো বলেন, প্রান্তের চেয়ে কেন্দ্রের দায়িত্ব অনেক বেশি। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উৎসব ঢাকাতেও করা যেতে পারে। সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতার অহংকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ঐতিহ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা তাঁর বক্তব্যের শুরুতে প্রয়াত লেখক হুমায়ুন আজাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক একটি গ্রন্থের উদ্ধৃতি হিসেবে বলেন, ‘বাংলাদেশ ছোট; কিন্তু এর এক প্রান্তের মানুষের কাছে অপরিচিত আরেক প্রান্ত।’ ‘ক্ষুদ্র’ শব্দটিতে আপত্তি জানালেও তিনি বলেন, ‘আমরা নেপালের চেয়ে অনেক ভালো আছি। আমাদের সংবিধান আমাদের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে আমাদের অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে।’
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহেদুল এমরান বলেন, পাবর্ত্য চট্টগ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে ‘অপারেশন উত্তরণ’-এর মাধ্যমে সেনাবাহিনী বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা দেওয়া ছাড়াও স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নগদ অর্থসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা দিচ্ছে।