‘জাতীয় স্কুল মিল নীতি-২০১৯’ ও কিছু কথা - দৈনিকশিক্ষা

‘জাতীয় স্কুল মিল নীতি-২০১৯’ ও কিছু কথা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

প্রায় কুঁড়ি বছর আগের কথা, মা থাকতেন সাভারে। মায়ের পাশের বাসার এক দম্পতি কোন একটা গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। গার্মেন্টসের মালিক প্রতিদিন সব কর্মচারীকে দুপুরের টিফিনে এক প্যাকেট করে এনার্জি প্লাস বিস্কুট দিতেন। দম্পতি তো আর প্রতিদিন তা খেতেন না। বাসা থেকেই দুপুরের খাবার নিয়ে যেতেন। খুব যে দিন খাবার নিতে পারতেন না সেদিন মালিকের পক্ষ থেকে পাওয়া এক প্যাকেট এনার্জি প্লাস বিস্কুট খেয়েই দিন পার করতেন। সপ্তাহে দুজনে ৬+৬=১২ প্যাকেট করে পেতেন। উনারা আশপাশে সে বিস্কুট বিক্রি করতেন। বাজারের দামের চেয়ে দুই টাকা কমে। সম্ভবত পাঁচ টাকা বিক্রি করতেন। মা ওদের কাছ থেকে সে বিস্কুট কিনতেন। নিজেরা খেতেন আর আমাদেরও দিতেন। ১০০ টাকা দিলে ২০ প্যাকেট দিতেন, আবার বোনাস হিসেবে এক প্যাকেট বেশি দিতেন। অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন সরকার ঘোষিত স্কুল শিক্ষার্থীদের টিফিনের বিষয়ে লিখতে এসে এ কি লিখছি। আসুন এবার মজার একটা গল্প জেনে নিই। সোমবার (২৮ অক্টোবর) সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও বলা হয়, বছর ৭-৮ আগের কথা। ছুটি পেলে বা ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যাই। মেয়েরা খালার (খালা শাশুড়ি) ঘরে গেলেই উনি ওদের শুকনো এক ধরনের বিস্কুট খেতে দেন। মেয়েরা কখনো খায় কখনো নিয়ে আসে আমার কাছে। এই নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। খালা ভালোবাসেন বলেই ওদের খেতে দেন। আমিও খেয়েছি। বিস্কুটের স্বাদ আছে তবে রস নেই। মানে পুরাই শুকনো। আমি ভেবেছি সেই গার্মেন্টসে চাকরি করার মতো খালাও বিস্কুটের প্যাকেট পায়। মেয়েরা খায় বলে গ্রাম থেকে আসার আগের দিন খালা প্রায় ১০-১১ প্যাকেট বিস্কুট এনে আমার হাতে দিলেন, বললেন- ‘বউ মা, তোমার মেয়েদের জন্যে নিয়ে যাও এগুলো। ওরা বাসায় খাবে।’

এত প্যাকেট একসঙ্গে দেখে আমি অবাক- এত বিস্কুট কই পেলেন খালা।

-ওই যে স্কুলে বাচ্চাদের দেয়, সেখান থেকেই।

-বাচ্চাদের দেন নাই।

-দিই তো, বেশি হলে নিয়ে আসি আমরা।

-খালা এই বিস্কুট তো আপনার আনার কথা নয়। আর আনলেও নিজের জন্যে ২-৪ প্যাকেট আনতে পারেন, তাই বলে এত এত্তো।

খালা শিক্ষকতা করেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সরকার স্কুলের শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করতে, শারীরিক চাহিদা মেটানোর জন্যে টিফিনের ব্যবস্থা করেছেন। সেই বিস্কুট খালা বাড়িতে নিয়ে আসেন। খালাকে জিজ্ঞেস করলেও কোন জবাব দিলেন না। অন্যদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারি খালা অনেককে এভাবে বিস্কুটের প্যাকেট দেন।

২০১০ সাল থেকে ডব্লিউএফওর সহযোগিতায় দেশের ১০৪টি দারিদ্র্যপ্রবণ উপজেলার সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্কুল ফিডিং হিসেবে বিস্কুট বিতরণ শুরু হয়। এছাড়া ২০১৩ সালে বরগুনার বামনা, জামালপুরের ইসলামপুর এবং বান্দরবানের লামা উপজেলায় পাইলট প্রকল্প হিসেবে দুপুরে রান্না করা খাবার বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়। চলতি বছর ৩১ ডিসেম্বর এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। প্রকল্পটির ধারাবাহিকতা রাখতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘জাতীয় স্কুল মিল’ নীতিমালা প্রণয়নের জন্য ২০১৬ সালে একটি কমিটি গঠন করে। ২০১৭ সালে এ নীতিমালার খসড়া প্রণয়ন করা হলেও তা কার্যকর হয়নি। সম্প্রতি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘জাতীয় স্কুল মিল নীতিমালা-২০১৯’র খসড়া চূড়ান্ত করেছে। তারই পরিপেক্ষিতে ‘জাতীয় স্কুল মিল নীতি-২০১৯’ খসড়া নীতিমালাকে বাস্তবে রূপ দিতেই ১৯ আগস্ট ২০১৯, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠেয় মন্ত্রিসভার বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বৈঠকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশের সব প্রাইমারি স্কুলে শিশুদের দুপুরের খাবার দেয়া হবে। বর্তমানে দেশের ১০৪টি উপজেলায় শুকনো ও রান্না করা খাবার দেয়া হচ্ছে। এর বদলে শুধু শুকনো খাবার দেয়ার প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে সরকার।

প্রতি বছর স্কুল মিলে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব আকরাম-আল-হোসেন জানান, বর্তমানে স্কুল মিলের ফান্ড দিচ্ছে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফও)। তবে আগামীতে এ প্রকল্প সরকারের টাকায় বাস্তবায়ন করা হবে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এ সংক্রান্ত ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) চূড়ান্ত করা হবে। এতে রান্না করা ও শুকনো খাবার দুটো প্রস্তাবই থাকবে। সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল যেটি পছন্দ করবে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

২০১০ থেকে শুরু হওয়া স্কুল মিল বর্তমানে দেশের ১০৪টি উপজেলার কিছু স্কুলে পরীক্ষামূলকভাবে রান্না ও শুকনো খাবার দেয়া হচ্ছে। এতে দেখা যায়, এসব স্কুলে শিক্ষার্থীর ভর্তি শতভাগ নিশ্চিত হয়েছে। আর স্কুলে শিক্ষার্থীর উপস্থিতির হার আগের তুলনায় ৫-১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যেসব স্কুলে রান্না করা খাবার দেয়া হচ্ছে সেখানে উপস্থিতির হার বেড়েছে ১১ শতাংশ আর শুকনো খাবার (বিস্কুট) দেয়া স্কুলগুলোতে বেড়েছে ৬ শতাংশ। শিক্ষার্থীদের রক্তস্বল্পতার হার কমেছে যথাক্রমে ১৬ দশমিক ৭ ও ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। এসব স্কুলের শিক্ষার্থী ঝরেপড়ার হারও কমেছে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সরকারের চলতি মেয়াদেই দেশের সব প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবার দেয়া হবে।

প্রস্তাবিত নীতিতে বলা হয়েছে-

‘প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী দেশের সব শিশুকে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে পর্যায়ক্রমে স্কুল মিল নীতির আওতায় আনা হবে। তাদের শিক্ষা, পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তায় যথার্থ আবদান রাখা যাবে। এ কার্যক্রম শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিসহ গ্রাম ও শহর, ধনী ও গরিবের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে শিক্ষার মানের ব্যবধান কমাতে সাহায্য করবে।’

শিক্ষার্থীদের মেধার উৎকর্ষ সাধন, চিন্তা ও কল্পনা শক্তির বিকাশ, সৃজনশীলতা এবং দক্ষ ও যোগ্য মানবসম্পদে পরিণত হতে ভূমিকা রাখবে। এটি কার্যকর হলে প্রাথমিক স্তরের সব শিক্ষার্থীর স্কুলে ভর্তি, উপস্থিতির হার বৃদ্ধি, পাঠে মনোনিবেশ ও বিদ্যালয় ধরে রাখতে অবদান রাখবে। শিশুদের পুষ্টির বিষয়ে এতে আরও বলা হয়েছে- ৩ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুদের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় শক্তির চাহিদার ন্যূনতম ৩০ শতাংশ স্কুল মিল থেকে আসা নিশ্চিত করা হবে। বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে ৫ দিন রান্না করা খাবার এবং একদিন উচ্চপুষ্টি মানসম্পন্ন বিস্কুট সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি, অভিভাবক ও স্থানীয় জনগণের সঙ্গে পরামর্শ করে খাবার মেনু নির্ধারণ করা যাবে। খাদ্য প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে উদ্ভিদ ও আবহাওয়ার ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে- সে বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

রহিমা আক্তার মৌ : সাহিত্যিক কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0043931007385254