‘নৌকায় আমাদের জন্ম, নৌকাতেই ভোট দেব’ - দৈনিকশিক্ষা

বেদেজীবনে ভোটের ভাবনা‘নৌকায় আমাদের জন্ম, নৌকাতেই ভোট দেব’

মিজানুর রহমান খান |

বংশী নদীর পারে পোড়াবাড়ি, আমলপুর ও কাঞ্চনপুর—এই তিনটি গ্রাম নিয়ে সাভারের বেদেপল্লি। ১৫ ডিসেম্বর দুপুরে পোড়াবাড়িতে পৌঁছালাম। সেখানকার একটি পোশাক কারখানার সেলাই মেশিনগুলো সেদিন বন্ধ ছিল। এই সেলাই মেশিনগুলো বেদে নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক। সেদিন কাজ ছিল না বলে সেখানে একসঙ্গে অনেক জনকে পাওয়া গেল।

শিক্ষার নিম্ন হারের বৃত্ত এই সম্প্রদায় দ্রুত ভাঙছে। এই বৃত্ত ভাঙাতে তাঁদের সাহায্য করছেন পুলিশের ডিআইজি (অ্যাডমিন অ্যান্ড ডিসিপ্লিন) হাবিবুর রহমান। তিনি তাঁদের পোশাক কারখানায় কাজের সুযোগ করে দিয়েছেন। ২০১৬ সালে জরিপ করে তিনি দেখেছেন, সাভারে তারা সংখ্যায় ১৫ হাজার। তাঁদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নও যে তাঁরা অর্জন করেছেন, ভোট নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তা বোঝা গেল।

বেদে সরদার আবদুস সাত্তার বললেন, বেদেপল্লির লোকেরা অজ্ঞ ছিল। বিগত সরকারগুলোর কেউ তাঁদের দেখেনি। এখন তাঁরা অভিভাবক পেয়েছেন। কাকে ভোট দেবেন—এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, তাঁদের এখানে ৫ হাজার ভোট আছে। সব ভোটই নৌকায় পড়বে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, ‘নৌকায় আমাদের জন্ম। নৌকাতেই ভোট দেব।’ পাশে থাকা একজন বললেন, ‘আগে আমাদের মধ্যে কেউ ভোট দিত না। লোকে ঘৃণা করত। শুধু ঘৃণার কারণে ভোট দিতে বাধা পেতাম। আমাদের বাচ্চাদের স্কুলে লেখাপড়া করতেও দিত না।’

মাস্টার মহাজন আবদুর সাত্তার খান কোচিং সেন্টারের কর্তা। বললেন, বাপ–দাদার পেশা ছেড়ে এখন তাঁদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়। চার বছরে (২০১৫–২০১৮) ১৩৭ জন এসএসসি, ৩৬ জন এইচএসসি এবং ১৩ জন স্নাতক পাস করেছে। এদের চার ভাগের এক ভাগ মেয়ে। তাঁদের অনেকে চাকরিও পেয়েছেন।

কথা বলে বোঝা গেল, এই বেদে সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে নাগরিক সচেতনতা অনেক বেড়েছে। ভোটের রাজনীতি নিয়েও তাঁরা ভাবেন।

হাসিনা আক্তার আগে শিঙা লাগাতেন। ‘দাঁতের পোকা’ তুলতেন। এখন পোশাক কারখানায় কাজ করেন। কাকে ভোট দেবেন—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি কোনো রকম ভনিতা না করেই বললেন, ‘নৌকায় দেব। শেখ হাসিনারে দেব।’ অমরপুরের মেয়ে পারুল এবারই ভোটার হয়েছেন। ভোট নিয়ে তাঁর খুব আগ্রহ দেখা গেল। শ্মশ্রুমণ্ডিত প্রবীণ মোহাম্মদ হোসেন আলী বললেন, ‘কেন ভোট দিতে যাব না? অবশ্যই যাব। ভালো ভোট হবে ইনশা আল্লাহ।’

ছবি তুলতে যাচ্ছিলাম। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া একজন ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ‘কী ছবি তোলেন? ১০ দিন আগে আমার ঘরবাড়ি সব পুড়ে গেছে। কেউ সাহায্য করছে না।’ এবার কি ভোট দেবেন—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ‘আল্লায় চাইলে ভোট দেব।’ ছয়–সাতজন বয়স্ক ও তরুণকে তাস খেলতে দেখা গেল। পাশে পানের দোকানে পান চিবুচ্ছিলেন লুৎফর রহমান। তাঁর ঘরে পাঁচটি ভোট। তিনি বললেন, ‘ভোট তো দিব, আমাদেরটা মার্কা মারা, একটাও ভুল নাই। সরকারই আমাদের ভোট।’ আইডি কার্ড দেখিয়ে বলেন, ‘তোমাদের কথামতো দেব না।’

আপনারা ঘরে ভোট নিয়ে কী আলোচনা করেন—এ প্রশ্নের জবাবে লুৎফর বলেন, ‘আমাদের কোনো আলোচনা নাই। আমাদের ভোট একটাই। সেটা নৌকা।’ মোহাম্মদ মোকসেদ আলী ভোট দেবেন কি না, বলতে ঈষৎ ঝাঁজ মিশিয়ে বললেন, ‘আমি ভোটার। ভোট দেব না কেন? একবার না, চারবার দেব।’ আশফারি বেগম আগেও ভোট দিয়েছেন, এবারও দেবেন। তিনি বললেন, ‘আশা করি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। আমার ফ্যামিলিতে যতগুলো ভোট আছে, আমি যা বলব, তা-ই।’

কথা বলে জানা গেল, তাঁদের জীবন বদলে দিয়েছেন ডিআইজি হাবিবুর রহমান। তিনি এখন তাঁদের নিয়ে একটি বই লিখছেন। হাবিবুরকে ‘ফেরেশতা’ বলেছেন তাঁদের অনেকেই। তাঁরা চাঁদা তুলে এমনকি ‘হাবিবিয়া জামে মসজিদ’ নামে একটি মসজিদ নির্মাণ শুরু করেন। এটির কাজ শেষ পর্যায়ে। হাবিবুরের কারণে তাঁরা নৌকার ভক্ত। সে কারণেই তাঁরা একচেটিয়া নৌকায় ভোট দেবেন।

অনেক আগের কথা নয় যে বেদেরা ভোট কী তা বুঝতেনই না। যাযাবর জীবনে ভোটের কোনো দাম ছিল না। আজও তাঁরা আটটি গোত্রে বিভক্ত। গোত্রগুলোর নামেই তাঁদের পেশার পরিচয়। যেমন সাপুড়েরা সাপ খেলা দেখায়, শান্দার চুরি ফিতা বিক্রি করে। বাজিগর ম্যাজিক খেলা দেখায়, গোকুলসার কাজ তাবিজ বিক্রি। লাউয়া মাছ শিকার করে। ব্যাজের পেশা বানরের খেলা। সরদার গোত্র হলো ওঝা ঝাড়ফুঁক। আর কবিরাজের কাজ ভেষজ টোটকা চিকিৎসা দেওয়া। কিন্তু এসব গোত্রের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, তাঁরা আর কেউ নিজেদের পেশাকে সম্মানিত ও মর্যাদাসম্পন্ন মনে করেন না। তার একটাই কারণ, সেটা হলো তাঁদের উপলব্ধিতে এসেছে, এ পেশার সঙ্গে মানুষের সঙ্গে প্রতারণার বিষয়টি জড়িয়ে আছে।

আমজাদ মণ্ডল সিলেট থেকে ছুটিতে এসেছেন। তিনি আগে সাপ খেলা দেখাতেন। এখন পুলিশে চাকরি করেন। এভাবে আরও অনেকের পেশা বদলে গিয়েছে। তাঁরা তঁাদের ভোটাধিকার নিয়ে সচেতন হয়েছেন। ওই গার্মেন্টস কারখানা, সেখানে ছয়টি মেয়ের সঙ্গে কথা হলো। পাঁচজনই এবারের নতুন ভোটার। সাভারের এই বেদে পাড়ায় অন্তত পাঁচ হাজার ভোটার আছেন।

রমজান আহমেদ ২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বরের পৌরসভা নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি মাত্র আড়াই শ ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন। তাঁর ধারণা, অচ্ছুত বিবেচনায় বেদে সম্প্রদায়ের বাইরের কোনো ভোট তিনি পাননি। তবে ভোটের সময় অনেক বেদে ভোটার তাঁদের যাযাবর জীবনে না থাকলে তাঁর বিজয় ছিল নিশ্চিত। ২ হাজার ৮৫০ ভোট পেয়েছিলেন। গত এক শতাব্দীর বেশি সময়ে রমজান আহমেদই বেদেজীবনে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সূচনাকারী। তিনি বেদেদের সংগঠন পোড়াবাড়ি সমাজ কল্যাণ সংঘের সাধারণ সম্পাদক। প্রায় ৩০০ যুবক এই সংঘের সদস্য। ধর্মবিশ্বাসে এই বেদেরা সুন্নি মুসলমান। এখানে বৃহত্তম বেদে উৎসব (চৌরশী) হয় প্রতি কোরবানির ঈদে। ৫৩ জেলায় থাকা ১৭  লাখের বেশি বেদের ঢল নামে তখন। তাঁদের সমতার ধারণা অসাধারণ। গত উৎসবে ৩৭টি গরু ৩ হাজার ৭৭৫ ভাগ (প্রতি চারজনে এক ভাগ) হয়েছিল।

বেদেরা পরিবর্তনের দিকে আসছে। তারা অন্যদের মতো মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছে। একটি ছেলে স্পেনে পাড়ি দিয়েছে। তারা সর্বসম্মতভাবে পুরোনো পেশা বদলাতে চায়। আসতে চায় নতুনের পথে।

লেখক: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক

সূ্ত্র: প্রথম আলো। 

স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.01288104057312