বিশ্ববিদ্যালয়ের pro-vice chancellor-এর বাংলা অর্থ প্রো-উপাচার্য বা সহ-উপাচার্য নয়। সঠিক বাংলা হবে ‘প্রোপাচার্য’। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো দেশের সর্বাপেক্ষা মেধাবীদের প্রধান কর্মস্থল। এই প্রতিষ্ঠান যদি 'প্রো-উপাচার্য' বা 'প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর' ব্যবহার করে, তবে তা ওই সব প্রতিষ্ঠানভুক্ত ও প্রতিষ্ঠান-সংশ্নিষ্টদের অক্ষমতাকেই নির্দেশ করে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চপদাসীনদের 'প্রোপাচার্য'-ব্যবহার-নির্দেশক একটি প্রজ্ঞাপনই শব্দটি প্রচলনের জন্য যথেষ্ট। সাম্প্রতিক এক লেখায় এমন মত দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. সাখাওয়াৎ আনসারী।
অধ্যাপক আনসারীর মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদ হলো 'চ্যান্সেলর'। পদটি সর্বোচ্চ হলেও তা আলংকারিক। বস্তুত প্রধান নির্বাহী হলেন ভাইস চ্যান্সেলর। এই পদ-পরবর্তী দুটি পদ হলো যথাক্রমে 'প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর' এবং 'ট্রেজারার'। দীর্ঘকাল ধরে বাংলায় 'চ্যান্সেলর' 'আচার্য', 'ভাইস চ্যান্সেলর' 'উপাচার্য' এবং 'ট্রেজারার' 'কোষাধ্যক্ষ' হিসেবে অভিহিত হলে 'প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর'কে বিশেষ কোনো বাংলা পারিভাষিক শব্দে নির্দেশ করা যায়নি। এর কারণটি নিতান্তই সরল- যথাযথ কোনো বাংলা শব্দ সৃষ্টি বা নির্বাচন করতে না পারা।
'প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর'-এর বাংলা করাটা কি খুবই জরুরি? এ বিষয়ে অধ্যাপক আনসারীর যুক্তি: অনেকেই বলতে পারেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যদি হল, হোস্টেল, একাডেমিক কাউন্সিল, সিনেট, সিন্ডিকেট, ডিন, লাউঞ্জ, ক্যাফেটেরিয়া ইত্যাদি চলতে পারে এবং তাতে যদি সমস্যা না হয়, তাহলে 'প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর' ব্যবহারে সমস্যা কোথায়? সমস্যা যে একেবারেই নেই, এমন নয়। 'প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর'ই যদি ব্যবহার করতে হয়, তাহলে 'চ্যান্সেলর'কে 'আচার্য', 'ভাইস চ্যান্সেলর'কে 'উপাচার্য', 'ট্রেজারার'কে 'কোষাধ্যক্ষ'ই বা করা হয়েছিল কেন? আমরাই বা এগুলো ব্যবহার করে যাচ্ছি কেন? তাহলে বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, রামেন্দ্রসুন্দর, রাজশেখরসহ অসংখ্য পণ্ডিত নানা বাংলা পারিভাষিক শব্দ কেন তৈরি করেছিলেন? কেনই বা নানাজন বাংলা পরিভাষা তৈরির মাধ্যমে বাংলা ভাষার বিকাশসাধনে প্রাণপাত করে যাচ্ছেন? 'ইউনিভার্সিটি' এবং 'কলেজ' চললেই বা কী ক্ষতি ছিল? কেনই-বা বিদ্যাসাগর 'বিশ্ববিদ্যালয়' এবং 'মহাবিদ্যালয়' প্রবর্তন করেছিলেন? 'কলেজ' উচ্চারণ 'মহাবিদ্যালয়' থেকে সহজতর হওয়া সত্ত্বেও কেন আমরা 'মহাবিদ্যালয়'কে বর্জন করছি না? 'প্রভোস্ট'-এর বাংলা 'প্রাধ্যক্ষ' কি চলছে না? আর 'হল', 'হোস্টেল' 'একাডেমিক কাউন্সিল', 'সিনেট', 'সিন্ডিকেট', 'ডিন', 'লাউঞ্জ', 'ক্যাফেটেরিয়া'র বাংলা করার যে আমরা প্রচেষ্টা নিইনি, সেটাই তো আশ্চর্যের। যে বাংলা ভাষাটি পৃথিবীর অন্যতম প্রধান শক্তিশালী ভাষা; যে ভাষাটির বয়স সহস্র্রোর্ধ্ব বছর; যে ভাষাটি মাতৃভাষার কথক বিচারে পৃথিবীর সপ্তম স্থানাধিকারী ভাষা; সেই ভাষাটিকেই কেন একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ভাষারই কাঁধে দাঁড়াতে হবে?
অধ্যাপক আনসারীর মতে, 'প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর' নির্দেশে বর্তমানে দুটি শব্দ বা শব্দগুচ্ছ ব্যবহূত হচ্ছে :ইংরেজি 'প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর' এবং 'প্রো-উপাচার্য'। 'প্রো-উপাচার্য'র স্থলে কখনও কখনও লেখা হয় 'প্রোউপাচার্য'। কিছুকাল আগে 'উপ-উপাচার্য' লেখারও চল ছিল, বর্তমানে যেটি নেই বললেই চলে।
প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর নিয়ে ড. আনসারী দুটি ঘটনার ঘটনা উল্লেখ করেন। ১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম একবার 'উপ-উপাচার্য' সম্বোধন করা এক দরখাস্ত নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের কাছে গেছেন। অধ্যাপক এমাজউদ্দীন তখন দরখাস্তের 'উপ' অংশটুকু কেটে 'প্রো' লিখে দিলেন। তাঁর ভাষ্য হলো, 'প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর' 'উপ-উপাচার্য' নয়।
২. অধ্যাপক সালাম দ্বিতীয়বার গেছেন বর্তমান প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদের কাছে। এবারের দরখাস্তে সম্বোধন- 'প্রো-উপাচার্য'। এবার অধ্যাপক সামাদ কাটলেন দরখাস্তের 'উপাচার্য' অংশটুকু। তিনি সেখানে লিখলেন- 'ভাইস চ্যান্সেলর'। তাঁর বক্তব্য ছিল যে 'প্রো-উপাচার্য' হলো ইংরেজি-বাংলার মিশ্রণ। দু'জনেই সঠিক কাজটি করেছেন। 'প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর' যেমন 'উপ-উপাচার্য' নয়, তেমনই মিশ্রভাষিক 'প্রো-উপাচার্য' না লেখাই উত্তম। দু'জনেই যথাযথ কাজটি করলেও বাংলাটি কিন্তু আমরা কারও কাছ থেকেই পেলাম না। 'প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর'-এর বাংলা কোনোভাবেই 'উপ-উপাচার্য' হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। কারণ 'প্রো'-র বাংলা 'উপ' নয়; 'ভাইস' বা 'ডেপুটি'র বাংলা 'উপ'। যেমন :'ভাইস প্রেসিডেন্ট' হলো 'উপরাষ্ট্রপতি', 'ডেপুটি ডিরেক্টর' হলো 'উপপরিচালক'। 'ভাইস'-এর বাংলা 'সহ'ও হয়। যেমন :'ভাইস প্রেসিডেন্ট'- 'সহসভাপতি'। 'ভাইস' 'সহ' হয় বলেই 'প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর'কে 'সহ-উপাচার্য' লেখাও ভুল, যদিও কোনো কোনো পত্রিকায় 'সহ-উপাচার্য' লেখা আমরা দেখি। এটি বর্জনীয়। 'সহ-উপাচার্য' লেখা যেত, যদি ইংরেজিটি 'ভাইস-ভাইস চ্যান্সেলর' হতো। 'সহ-উপাচার্য' এই বিচারেও অবাঞ্ছনীয় যে 'সহ+ উপাচার্য= সহোপাচার্য' হলেও এবং সন্ধিটি কাম্য হলেও তেমনটি লেখা হচ্ছে না। 'প্রো-উপাচার্য' শব্দটি বাংলা এবং ইংরেজির মিশ্রণ হওয়াতে বর্জনীয়। 'বাংলিশ' বর্তমানে একটি শব্দ হিসেবে ব্যাপকভাবে চলছে। 'বাংলা'র 'বাং' এবং 'ইংলিশ'-এর 'লিশ' যোগে 'বাংলিশ'। 'প্রো-উপাচার্য' শব্দটির প্রথমাংশ ইংরেজি, শেষাংশ বাংলা হওয়ায় শব্দটিকে 'বাংলিশ' না বলে 'ইংলা' ('ইংলিশ'-এর 'ইং' এবং 'বাংলা'র 'লা' যোগে) বলা অধিকতর উত্তম। 'প্রো'র বাংলা যদি 'উপ' বা 'সহ' না লেখা যায়, যদি ইংলা 'প্রো-উপাচার্য' না লেখা যায়, তাহলে কী লিখব?
ড. আনসারীর মতে, ইংরেজি 'প্রো' একটি আদ্য প্রত্যয় (প্রিফিক্স)। এর মূল অর্থ 'পক্ষে' (ইন ফেভার অব; যেমন :প্রোচাইনিজ, প্রোরিভলিউশনারি ইত্যাদি), 'যার মতো কাজ করছে' (অ্যাকটিং অ্যাজ; যেমন :প্রোনাউন)। 'প্রোনাউন' 'নাউন'-এর 'উপ' বা 'সহ' নয়। 'প্রোনাউন' কিন্তু 'নাউন'-ই। অর্থাৎ 'প্রোনাউন' 'নাউন'-এরই কাজ করে। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি স্পষ্ট করা যাক। 'কামাল ইজ এ গুড বয়। হি গৌজ টু স্কুল এভরিডে।' এখানে 'কামাল' নাউন, 'হি' প্রোনাউন। 'হি' কিন্তু কামালই, অন্য কেউ নয়। ঠিক তেমনইভাবে 'প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর' কিন্তু 'ভাইস চ্যান্সেলর'ই। এখন প্রশ্ন- ইংরেজি 'প্রো'কে বাংলা কী দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায়? বাংলায় রয়েছে একটি উপসর্গ :'প্র'। এটির বেশ কিছু অর্থদ্যোতনার একটি 'প্রকৃষ্ট', আর একটি 'আধিক্য নির্দেশ'। এই দুই অর্থের উদাহরণ হতে পারে :'প্রকম্প' (অতিশয় কম্পন), 'প্রকীর্তি' (বিশেষ কীর্তি), 'প্রখ্যাত' (বিশেষ খ্যাত), 'প্রদীপ্ত' (প্রকৃষ্টরূপে দীপ্ত) ইত্যাদি। উভয় দ্যোতনায়ই ইংরেজি 'প্রো'র স্থলে বাংলা 'প্র' ব্যবহার করা যেতে পারে। তাহলে 'প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর'-এর বাংলাটি দাঁড়ায় 'প্র+উপাচার্য'। সন্ধির নিয়মে 'অ+উ = ও' ধরে 'প্র+উ = প্রো' হয়। এই সূত্রেই 'প্র+উপাচার্য = প্রোপাচার্য' ('প্র+উক্ত = প্রোক্ত', 'প্র+উচ্চারণ = প্রোচ্চারণ', 'প্র+উজ্জ্বল = প্রোজ্জ্বল' যেমন)। এভাবেই 'প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর'-এর চমৎকার ব্যবহার্য বাংলা শব্দটি হতে পারে 'প্রোপাচার্য'।