‘বখাটেরা বাঁচতে দিল না স্কুলছাত্রী শুক্লাকে’ - দৈনিকশিক্ষা

‘বখাটেরা বাঁচতে দিল না স্কুলছাত্রী শুক্লাকে’

কলাপাড়া (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি |

সম্ভ্রম বাঁচানো ও স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা নিয়ে বখাটেদের হুমকি এবং যৌন হয়রানির শিকার হয়ে মৃত্যু বেছে নিলে নবম শ্রেণীর ছাত্রী হৈমন্তি শুক্লাকে। অথচ উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন ছিল তার। সদা হাস্যোজ্জ্ব¡ল ও মেধাবী এই শিক্ষার্থীকে নিয়ে মা-বাবার ছিল অনেক স্বপ্ন। কিন্তু নিজের সম্ভ্রম, পরিবারের সম্মান ও বাবার জীবন রক্ষা করতে সব স্বপ্ন ছাইয়ের মতো উড়িয়ে দিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হলো তাকে।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার খেপুপাড়ার সরকারি মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী হৈমন্তি শুক্লা যৌন হয়রানির লজ্জা সইতে না পেরে গত ২৭ অক্টোবর দুপুরে নীলগঞ্জ ইউনিয়নের হাজীপুর গ্রামের ভাড়াবাসার নিজ কক্ষে ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে। ওইদিন এ ঘটনায় কলাপাড়া থানায় ইউডি মামলা করা হলেও ২৯ অক্টোবর শুক্লার বাবা ও কলাপাড়ার হাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির অভিযোগ কেন্দ্রের ইনচার্জ সুনীল চন্দ্র হাওলাদার পাঁচ বখাটের বিরুদ্ধে কলাপাড়া থানায় মামলা করেন। মামলায় কলাপাড়া পৌর শহরের রহমতপুর এলাকার সেলিম মেকারের ছেলে সুমন (২০), ইউনুচের ছেলে শান্ত (২০), তার চাচা জহির (৪০), মিজানুর রহমানের ছেলে শিশির (২২) ও নাইয়াপট্টির জিসানকে (২০) আসামি করা হয়।

পটুয়াখালীর র‌্যাবের সহায়তায় প্রধান আসামি সুমর ও জহিরকে বুধবার রাতে গ্রেফতার করে পুলিশ। বৃহস্পতিবার তাদের আদালতে প্রেরণ করা হয় এবং সুমনকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয়ার জন্য আদালতে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই নুরুজ্জামান।

যে কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হলো শুক্লাকে : পল্লী বিদ্যুৎ কর্মকর্তা সুনীল চন্দ্র হাওলাদার গত জানুয়ারিতে হাজীপুর পোস্টিং হওয়ার পর কলাপাড়া পৌর শহরের রহমতপুর এলাকায় মোসলেম আলীর বাসায় চার মেয়ে, এক ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়ায় ওঠেন। তার সেজমেয়ে হৈমন্তি শুক্লা খেপুপাড়া সরকারি মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর মানবিক বিভাগের ছাত্রী ছিল। পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী শুক্লা স্কুল, বাসা ও প্রাইভেট পড়েই দিনের অধিকাংশ সময় পার করত।

সুনীল হাওলাদার জানান, বখাটে সুমন প্রায়ই তার সহযোগীদের নিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে শুক্লাকে প্রেম নিবেদন করত ও কুপ্রস্তাব দিত। বিষয়টি শুক্লা তার মা সবিতা রানীকে জানায়। মেয়ের সম্ভ্রম রক্ষায় বিষয়টি তিনি সুমনের চাচা জহিরকে জানান। কিন্তু জহির বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে তাকে বলেন, আজকাল ছেলেমেয়েরা প্রেম-ট্রেম করে থাকে। এতে কিছু হয় না। সুমনের অভিভাবকরা বিষয়টি গুরুত্ব না দেয়ায় সুমন আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং তার বন্ধুদের নিয়ে শুক্লাকে প্রতিনিয়ত হয়রানি করতে থাকে। তিনি বলেন, সুমন ও তার বখাটে বন্ধুদের ক্রমাগত হুমকি এবং বখাটেপনায় অতিষ্ঠ হয়ে গত সেপ্টেম্বরে তিনি রহমতপুরের ভাড়াবাসা ছাড়তে বাধ্য হন। সন্তানদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে কর্মস্থল হাজীপুরে সুমন আলমের বাসায় ভাড়ায় ওঠেন। হাজীপুর থেকে প্রতিদিন প্রায় ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে শুক্লা স্কুলে আসত। এ স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে আবার শুরু হয় সুমনের বখাটেপনা। প্রতিনিয়ত রাস্তায় অটোরিকশা থামিয়ে মেয়েকে উত্ত্যক্ত করত এবং বিয়ের জন্য চাপ দিত। গত ২৬ অক্টোবর সকালে প্রতিদিনের মতো শুক্লা অটোরিকশায় করে স্কুলে যাওয়ার পথে সুমন মোটরসাইকেলে করে তার সহযোগীদের নিয়ে রাস্তায় অটোরিকশা থামিয়ে প্রেমের প্রস্তাবসহ বিয়ের জন্য চাপ দেয়। তাকে বিয়ে না করলে বাবাকে খুন করাসহ শুক্লাকে এসিডে ঝলসে দেয়ার হুমকি দেয়। এক পর্যায়ে শুক্লার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেয় এবং টানাহিঁচড়া শুরু করে সুমন। শুক্লা তাকে ধাক্কা দিয়ে অটো থেকে নেমে বাসায় চলে আসে। বখাটেদের অব্যাহত হুমকি, মানসিক যন্ত্রণা ও শারীরিক লাঞ্ছনা সহ্য করতে না পেরে ২৭ অক্টোবর গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে হৈমন্তি শুক্লা।

সহপাঠীদের বক্তব্য : শুক্লার মৃত্যু সংবাদ শুনে শোকে আচ্ছন্ন তার সহপাঠীরা। দু‘দিন আগেও বেঞ্চে পাশাপাশি বসে যাদের সঙ্গে ক্লাস করত, হঠাৎ তার আত্মহননের বিষয়টি কেউ মেনে নিতে পারছে না। শুক্লার সহপাঠী তানজিলা, সুরাইয়া আক্তার ও তানিয়া জানায়, তিন-চার মাসে শুক্লা তাদের কাছে বখাটে সুমনের কথা বলেছে। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে তাকে উত্ত্যক্ত করত তারা। এতে মাঝে মধ্যে ক্লাসে সে চুপ করে থাকত। অত্যন্ত মেধাবী এ শিক্ষার্থী ছিল অত্যন্ত মিশুক। সবার সঙ্গে ছিল তার হৃদ্রতাপূর্ণ সম্পর্ক। বখাটেদের কারণে তাকে বাসাও বদল করতে হয়েছে। কিন্তু রক্ষা পায়নি যৌন হয়রানি থেকে। শুক্লার আত্মহত্যার প্ররোচনায় যারা জড়িত, তাদের শাস্তি কামনা করে তারা।

শিক্ষকদের বক্তব্য : শুক্লার শ্রেণীশিক্ষক সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, অত্যন্ত মেধাবী ও ভদ্র মেয়ে ছিল সে। গত ২৮ অক্টোবর ক্লাসে হাজিরা খাতার রোল কল করার সময় ২১৮ নম্বর রোল নম্বর কল করলে ছাত্রছাত্রীরা সবাই নিশ্চুপ হয়ে যায়। তখন জানতে পারেন শুক্লার মর্মান্তিক মৃত্যুর বিষয়টি। তা খুবই বেদনাদায়ক।

প্রধান শিক্ষক মো. আবদুর রহিম বলেন, ক্লাস নাইনের মেধাবী এই মেয়ে কেন আত্মহত্যা করবে। তারা শুক্লার মৃত্যুর সঠিক কারণ অনুসন্ধানের দাবি জানান প্রশাসনের কাছে।

বর্তমান পরিবারের অবস্থা : শুক্লার মৃত্যুর পর থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তার মা সবিতা রানী হাওলাদার। ঘরের মধ্যে বোনের ঝুলন্ত লাশ দেখে বাকরুদ্র তার ভাইবোনরা। যে ঘরে ভাইবোনরা হৈ-হুল্লোড়, হাসি-ঠাট্টা ও ঝগড়া করে সময় কাটাত- ওই ঘরে এখন কবরের নিস্তব্ধতা। সদা হাস্যোজ্জ্বল শুক্লার মৃত্যুর পর থেকে বাবা সুনীল চন্দ্র স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে পটুয়াখালীর তার বোনের বাসায় উঠেছেন। এমনকি যে মাটি তার মেয়েকে বাঁচতে দেয়নি, ওই কলাপাড়ায় তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার করেননি।

প্রশাসনের বক্তব্য : মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কলাপাড়া থানার এসআই নুরুজ্জামান জানান, শুক্লাকে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে মামলা হয়েছে। মামলা নং ৩২/২৯-১০-১৯। মামলার পাঁচ আসামির মধ্যে ইতোমধ্যে দু’জনকে গ্রেফতার করে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে এবং প্রধান আসামি সুমনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে।

কলাপাড়া থানার ওসি (তদন্ত) আসাদুর রহমান জানান, পুলিশ খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে গিয়ে শুক্লার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পটুয়াখালী প্রেরণ করে। তার মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের জন্য ঘটনার পর থেকেই পুলিশ কাজ করছে। মামলার অন্য তিন আসামিকেও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে জানান।

এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0075869560241699