‘কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়া অহেতুক সড়কে গাড়ি নিয়ে বের হওয়ায় গড়ে প্রতিদিন শতাধিক মামলা হচ্ছে। এটা দরকার হতো না, যদি মানুষ সরকারি নির্দেশনা মেনে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকত। নিজেরা ঝুঁকি নিয়ে মানুষকে সচেতন করছি। ঘর থেকে বের হওয়ার কারণ জানতে চাচ্ছি। কিন্তু খুব কম লোকই যৌক্তিক কারণ দেখাতে পারছে। আর এ কারণেই ঝুঁকিমুক্ত করা যাচ্ছে না শহর। তাই বলতে চাই, মানুষ সচেতন না হলে পুলিশ বেটে খাওয়ালেও কাজ হবে না। আমরা আর কী-ই বা করতে পারি!’ কথাগুলো পুলিশ সার্জেন্ট সাগর কুমার ঘোষের। করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালনকারী এই তরুণ সার্জেন্ট অনেকটা আক্ষেপ করে গতকাল এসব কথা বলছিলেন। এ সময় তাঁর অদূরে চেকপোস্টে গাড়ির চাপে সরকার ঘোষিত এই ছুটির আবহেও রীতিমতো যানজট লেগে যায়। সোমবার (৬ এপ্রিল) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রেজোয়ান বিশ্বাস।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, সরেজমিনে গতকাল বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত রাজধানীর রমনা, রামপুরা, হাতিরঝিল, তেজগাঁও, বনানী, গুলশান ও বাড্ডা এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, সড়কে অন্য যে কোনো দিনের চেয়ে প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, মিনিট্রাক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মিনিবাস ও রিকশার সংখ্যা বেশি। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার কারণ জানতে চাইলে অটোরিকশাচালক আকবর আলী বলেন, ‘টানা ১০ দিন ঘর থেকে ঠিকমতো বের হতে পারিনি। ঘরে খাবার নাই। পোলাপাইন না খেয়ে আছে। বাবা হিসেবে এটা আর সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই বের হয়েছি।’
তবে সবাই আকবর আলীর মতো সন্তানদের খাবারের জোগান দিতে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হননি। অনেকে যৌক্তিক কারণ ছাড়াই গাড়ি নিয়ে বের হয়েছেন। এমন ৫০ জন গাড়িচালকের বিরুদ্ধে গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মামলা করেছেন সার্জেন্ট সাগর কুমার। একই সড়কে অবস্থান নেয়া আরও সার্জেন্ট করেছেন ৫০টির বেশি মামলা। এসব মামলার কারণ জানতে চাইলে সার্জেন্ট সাগর বলেন, ‘করোনা ভাইরাসের কারণে মানুষকে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলেছে সরকার। শুধু যৌক্তিক কারণে, বিশেষ করে চিকিৎসার প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হতে পারবে। কিন্তু এরপর অনেকেই যৌক্তিক কারণ ছাড়াই রাস্তায় বের হয়ে করোনাঝুঁকি ছড়াচ্ছে।’ সার্জেন্টরা এই মুহূর্তে গাড়ির কাগজ দেখার চেয়ে করোনা সচেতনতা না মানার কারণে মামলা দিচ্ছেন।
সরেজমিনে গিয়ে আরও দেখা যায়, রাস্তায় অন্যান্য দিনের চেয়ে প্রচুর মানুষ। এ সময় সড়ক ধরে হেঁটে যাওয়া সাগর নামে এক যুবক জানান, তিনি তেজগাঁওয়ের একটি গার্মেন্টে কাজ করেন। গত বৃহস্পতিবার সরকারি ছুটিতে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন। কাজে যোগ দিতে গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছেন গতকাল। তিনি বলেন, ‘এখন শুনছি ১৪ তারিখ পর্যন্ত সরকার ছুটি বাড়িয়েছে।’ তাঁর মতো আরও অনেককে গতকাল হঠাৎ করেই রাজধানীতে দেখা যায়। গত কয়েক দিনে এই চিত্র ছিল না। এ কারণে পুলিশের চেকপোস্টও বেড়েছে। সেই সঙ্গে সড়কে অন্যান্য দিনের চেয়ে গাড়ির সংখ্যাও বেশি। পুলিশ কোনোভাবেই এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। সড়কে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আর কত মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করব। ভালো কথা কেউ শুনতেই চায় না। উল্টা পুলিশকে ধমক দিয়ে বলে, আপনে শুধু মাস্ক পড়ে ডিউটি করছেন কেন। আপনার পিপিই কই? এর পরও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে মানুষকে বোঝাচ্ছি।’
গতকাল দেশে আরও একজনের মৃত্যুর পাশাপাশি এক দিনে ১৮ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হওয়ার খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লেও মানুষ ঘরে থাকেনি। সড়কে পুলিশ, র্যাবসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকলেও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। বাড্ডার পাশাপাশি গতকাল সরেজমিনে রমনা থানার সামনে থেকে হাতিরঝিলে এসে দেখা যায় সর্বত্রই পুলিশ সদস্যরা সতর্কাবস্থায় রয়েছেন। হাতিরঝিলেও লোকজন আছে। অনেকেই হাতিরঝিল এলাকায় ঘোরাঘুরি করছিল।
তবে করোনা ভাইরাসের মহামারি নিয়ন্ত্রণে চলমান দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে জরুরি সেবার সঙ্গে নিয়োজিতরা ছাড়া রাজধানীকে কেন্দ্র করে মানুষের আগমন-বহির্গমন ঠেকাতে কঠোর হতে বলেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) জাবেদ পাটোয়ারী। গত শনিবার দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গার্মেন্ট শ্রমিকসহ হাজার হাজার মানুষের ঢাকামুখী ঢল নামার পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে রাতেই তিনি এ নির্দেশনা দেন।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, ‘নভেল করোনা ভাইরাসের এই দুর্যোগময় পরিস্থিতির মধ্যে ঢাকার বাইরে থেকে ছুটে আসা শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষ যেন ঢাকায় প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে আইজিপির নির্দেশ সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। তাঁরা নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছেন।’