‘ম্যাজিস্ট্রেট বলেছিলেন প্রিন্সিপাল খারাপ ...তুমি গেছ কেন’ - দৈনিকশিক্ষা

নুসরাত হত্যা‘ম্যাজিস্ট্রেট বলেছিলেন প্রিন্সিপাল খারাপ ...তুমি গেছ কেন’

নিজস্ব প্রতিবেদক |

নুসরাত জাহান রাফির মা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যে মামলা করেছিলেন, তা প্রমাণ করতে না পারলে ৫০ লাখ টাকার মানহানির মামলা করার হুমকি ছিল তাদের বিরুদ্ধে। অধ্যক্ষের লোকজন এ হুমকি দিয়েছিল। সিরাজের কুকর্মের বিচার চাইতে গেলে মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও ফেনীর এডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) পিকেএম এনামুল করিম নুসরাতের মাকে জানিয়েছিলেন, 'আপনারা যে মামলা করেছেন তা প্রমাণ করতে না পারলে অধ্যক্ষের লোকজন আপনাদের বিরুদ্ধে মামলা করবে।' এডিএম নুসরাতকে এও বলেছিলেন, 'প্রিন্সিপাল খারাপ সবাই জানে। তুমি তার কাছে গেছ কেন। যখন গেছ তখন হজম করতে পারলে না কেন।'

এখন নুসরাত তার জীবন দিয়েই প্রমাণ করলেন- তার পরিবার যে মামলা করেছে, তা সঠিক ছিল। প্রাণের বিনিময়ে অধ্যক্ষের লোকজনের মানহানির মামলা থেকে বাঁচলেন নুসরাত ও তার পরিবার। পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্ত কমিটির কাছে নুসরাতের সঙ্গে ঘটে যাওয়া নির্মম দৃশ্যপটের আদ্যোপান্ত তুলেন ধরেন তার মা শিরিনা আক্তার। যেটি তদন্ত কমিটির কাছে তার 'অফিসিয়াল স্টেটমেন্ট' বলে বিবেচিত হবে। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ নুসরাতকে বলেছিলেন, তার অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি হলে তাকে অর্থ দেওয়া হবে। শিরিনা আক্তার জানান, আনুমানিক ছয় মাস আগে একদিন বিকেলে নুসরাত মাদ্রাসা থেকে ফিরে বাসায় কান্নাকাটি  করছিল। জানতে চাইলে নুসরাত জানায়, ওই দিন তাকে ক্লাসে খুঁজতে গিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজ তাকে পাননি। পরে মাদ্রাসার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা হয় নুসরাতের। ওই সময় নুসরাতকে তিনি বলেন, কথা আছে। আপনার সঙ্গে কোনো কথা নেই বলে হেঁটে চলে যেতে চাওয়ার পরপরই নুসরাতের ওড়না ধরে টান দেন সিরাজ। ওই ঘটনার পর বাসায় এসে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। সে রেশ কাটতে না কাটতেই আবার কিছুদিন আগে (২৭ মার্চ) নুসরাতকে নিজ কক্ষে ডেকে নেন সিরাজ। তার কথামতো কাজ করলে পরীক্ষার ফি দেওয়া লাগবে না বলে জানান তিনি। উল্টো নুসরাতকে অর্থ দেওয়ার প্রস্তাব দেন অধ্যক্ষ। এমন প্রস্তাবে কোনো সাড়া না পেয়ে সিরাজ বলেন, 'তুই অন্য ছেলেদের সঙ্গে কথা বলিস। আমার সঙ্গে কথা বললে সমস্যা কোথায়!' এর উত্তরে নুসরাত বলে, 'আপনি আমার বাবার মতো, আপনি আমার শিক্ষক। অন্য ছেলেদের সঙ্গে আপনার কি তুলনা চলে?'

নুসরাতের মা আরও বলেন, ২৭ মার্চ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ঢোকার আগ মুহূর্তে ছেলে নোমানের কাছে তিনি জানতে পারেন, মাদ্রাসায় নুসরাতের গায়ে হাত দিয়েছেন সিরাজ। এটা জানার পরপরই তিনি সোনাগাজী ফাজিল মাদ্রাসায় যান। অধ্যক্ষের রুমে ঢুকে তিনি তার কাছে জানতে চান, কোন সাহসে তার মেয়ের গায়ে হাত দেওয়া হলো। উত্তরে সিরাজ তাকে বলেন, কোন সাহসে তার কক্ষে প্রবেশ করেছেন নুসরাতের মা। এটা তার অফিস রুম। তখন নুসরাতের মা বলেন, 'এটা অফিস রুম নয়, এটা ব্যাভিচারের রুম।' এ সময় কারও ফোন পেয়ে অধ্যক্ষের কক্ষে ঢোকেন এসআই ইকবাল। তিনি এসে জানতে চান সেখানে কী ঘটেছে। এর উত্তরে অধ্যক্ষ বলেন, 'তার কক্ষে ঢুকে নুসরাতের মা নাটক করছে।' এ সময় অধ্যক্ষ হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে অন্যরকম ভান করতে থাকেন। এরপর এসআই ঘটনা জানতে নুসরাতকে বাসা থেকে মাদ্রাসায় ডেকে আনার কথা বলেন। ছেলে নোমানের সঙ্গে নুসরাতকে মাদ্রাসায় আনার পর অধ্যক্ষের কক্ষে নেওয়া হয়। তখন অধ্যক্ষ সিরাজকে দেখে অচেতন হয়ে পড়েন নুসরাত। নুসরাতের ওই দশা দেখার পর এসআই ইকবাল বলেন, 'এই মেয়ে ঢং করো না। তোমার সঙ্গে এমন কিছু হয়নি যে বেহুঁশ হয়ে যেতে হবে। এগুলো আমরা জানি।' এরপর এসআই ইকবাল নুসরাতের মুখে পানি মারেন। এরপর তিনি কিছুটা চেতনা ফিরে পেলেও কথা বলতে পারছিলেন না। তখন পুলিশের ওই সদস্য নুসরাতের বান্ধবী ফুর্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। পরে এসআই ইকবাল মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সহসভাপতিকে বলেন, 'তাদের থানায় নিয়ে যেতে হবে।' এরপর নুসরাত, নোমান, রায়হান ও নুসরাতের বান্ধবী নিশাত, ফুর্তিসহ থানায় যান তারা। মাদ্রাসার পিয়ন নুরুল আমিনও থানায় যান। ওসি তার রুমে নুসরাত, নিশাত ও ফুর্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। নুসরাতের কারও সঙ্গে প্রেম ছিল কি-না তা জানতে ওসি নুরুল আমিনকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেন। উত্তরে নুরুল আমিন বলেন, 'নুসরাতের সঙ্গে কারও প্রেম নেই।' অধ্যক্ষের নির্দেশে তার কক্ষে নুসরাতকে ডেকে নেন নুরুল, এটা ওসিকে জানান তিনি। পরে কম্পিউটারে এজাহার প্রস্তুত করে বাদীকে স্বাক্ষর করতে বলেন ওসি।

শিরিনা আক্তার আরও বলেন, পরদিন ২৮ মার্চ নুসরাতের জবানবন্দি রেকর্ড করেন ম্যাজিস্ট্রেট। আদালতে যাওয়ার সময় তারা পথে দেখেন, অধ্যক্ষের পক্ষে শিক্ষকসহ অন্যরা মানববন্ধন করছে। এই দৃশ্য দেখে নুসরাত তার মাকে আফসোস করে বলেন, 'ঘটনার পর মাদ্রাসার শিক্ষক আফসার ও হারুন হুজুরকে জানিয়েছি, তাদের বাবার মতো শ্রদ্ধা করি। অথচ তারাই অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন করছে।' এসব দেখে নুসরাত মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। আদালত থেকে ফেরার সময় নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করলে এসআই ইকবাল তাদের বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দেন। ৪ এপ্রিল সকাল আনুমানিক ১১টার দিকে মেয়ে নুসরাত ও ছেলে নোমানকে নিয়ে মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সভাপতি পিকেএম এনামুল করিমের অফিসে যান শিরিনা। সিরাজের বিরুদ্ধে অভিযোগটি জানাতে শুরু করলে পরিচালনা কমিটির সভাপতি বলেন, 'এখন কেন এসেছেন? আপনারা তো মামলা করে ফেলেছেন। মামলা করার আগে এলে দেখতাম কী করা যায়।' তখন নুসরাত তাকে বলেন, 'আপনি আমার বাবার মতো। আপনি আমার কথাগুলো শুনুন।' এর উত্তরে এনামুল বলেন, 'তোমার বাবাকে মাদ্রাসায় বসানোর জন্য এ রকম নাটক সাজিয়েছ।' পরিচালনা কমিটির সভাপতির এমন বক্তব্য শোনার পর মর্মাহত হয়ে বাসায় ফেরত যায় নুসরাতের পরিবার।

নুসরাতের মা আরও বলেন, ঘটনার দিন ৬ এপ্রিল আনুমানিক সকাল ৯টার দিকে ভাই নোমানকে নিয়ে পরীক্ষার হলের দিকে রওনা হন নুসরাত। বোনকে পরীক্ষার হলে ঢোকানোর পর মাকে ফোন করে নিশ্চিত করেছিলেন তিনি। ওই দিনই সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নোমান তার মাকে ফোন করে জানান, নুসরাতের গায়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। জামা-কাপড় নিয়ে যেতে বলেন। ফেনী সদর হাসপাতালে গিয়ে নুসরাতকে ওই অবস্থায় দেখেন তিনি। নুসরাত তখন তার গায়ে ওড়না জড়িয়ে দিতে বলেন মাকে।

হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0051569938659668